লোকসভা ভোটপর্ব মিটতেই নির্বাচন কমিশনের দাবি ছিল, দেশে শান্তিপূর্ণ এবং সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছে ভোটপ্রক্রিয়া। কিন্তু বিরোধীদের পাল্টা দাবি, অশান্তির আগুন ছড়াতে পারে 'ভোটমেশিন'কে ঘিরে। তাঁরা এও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে 'ম্যাজিক ফিগার' পাওয়ার লক্ষ্যে ভোট গণনায় বদল হতে পারে ইভিএম, কারচুপি হতে পারে ভিভিপ্যাট মেশিনেও। এই মর্মে বিরোধীরা নির্বাচন কমিশনের কাছে আর্জি জানালে সেই আবেদন খারিজ করে দেয় কমিশন। আর্জি খারিজের পিছনে কমিশনের বক্তব্য ছিল, লোকসভা নির্বাচনে ব্যবহৃত সব মেশিন "সম্পূর্ণ নিরাপদে" কমিশনের স্ট্রংরুমে রাখা আছে।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ঘিরে ওঠা ইভিএম বদলের জল্পনাকে কার্যত উড়িয়ে দিয়ে নির্বাচন কমিশন বলে, "আমরা খুব জোর দিয়ে এবং স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই যে ইভিএম ঘিরে ওঠা সব ধরনের অভিযোগ এবং প্রতিবেদন সম্পূর্ন ভুল এবং এই অভিযোগ অযৌক্তিক। ভিডিওতে যে দৃশ্য দেখা গেছে তার সঙ্গে 'নির্বাচনে ব্যবহৃত ইভিএম' মেশিনগুলির কোনও সম্পর্ক নেই। অব্যবহৃত রিজার্ভ ইভিএম মেশিন দেখা গেছে ভিডিওটিতে। তবে রিজার্ভ ইভিএম পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনও রকম গাফিলতি কিংবা অনিয়মের ক্ষেত্রে সব ধরনের তদন্ত করা হয়েছে, এমনকি যিনি বা যাঁরা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধেও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।"
প্রসঙ্গত, উত্তরপ্রদেশের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় ইভিএম বদলের (কয়েকটি রিজার্ভ ইভিএম পাওয়া যায় কিছু কেন্দ্রের বাইরে), সেই প্রসঙ্গে কমিশন জানায়, "নির্বাচনে ব্যবহৃত সব ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট মেশিনগুলিকে সঠিকভাবে সিল করা হয়েছে এবং সমগ্র প্রক্রিয়াটির একটি ভিডিও তুলে রাখা হয়েছে।"
আরও পড়ুন: ইভিএমে কারচুপি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের
ভোটগণনা প্রসঙ্গে বিরোধীদের আশ্বাস দিয়ে কমিশন জানায়, "গণনা প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সিসিটিভি ফুটেজের আওতায় থাকবে সমগ্র প্রক্রিয়াটি। প্রতিটি স্ট্রংরুম পাহারার দায়িত্বে থাকবে কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী, এবং গণনা চলাকালীন প্রার্থী বা তাঁদের মনোনীত এজেন্টরা স্ট্রংরুমে উপস্থিত থাকতে পারবেন। ভোট গণনার দিন প্রার্থীদের উপস্থিতিতেই খোলা হবে স্ট্রংরুম, এবং সমস্ত প্রক্রিয়াটির ভিডিও করা হবে। গণনা শুরু হওয়ার আগে ইভিএম মেশিনের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তার ট্যাগ, সিল এবং কেন্দ্রভিত্তিক সিরিয়াল নম্বর দেখানো হবে উপস্থিত প্রার্থী বা তাঁদের এজেন্টদের।" এদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ২২টি বিরোধী দল কমিশনের কাছে জানায়, ভিভিপ্যাট মেশিন যাচাইয়ের সময় কোনও অসঙ্গতি পেলে সংশ্লিষ্ট বিধানসভা কেন্দ্রের প্রত্যেকটি পোলিং বুথের ১০০ শতাংশ ভিভিপ্যাট পেপার স্লিপ গুনে দেখা উচিত। মনে করা হচ্ছে এই আবেদনের জবাব আজ কমিশনের তরফ থেকে দেওয়া হতে পারে।
কংগ্রেস নেতা তথা আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি জানান যে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে বুধবার একটি মিটিংএর আয়োজন করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়, যেখানে বিরোধীদের সব আর্জি শোনা হবে। যদিও কংগ্রেসের এই নেতা বলেন, নির্বাচন কমিশনের "শারীরিক ভাষা ইতিবাচক নয়", কাজেই মিটিং ফলপ্রসূ হবে বলে কোনও আশা রাখছেন না তাঁরা। তবে বিজেপির বক্তব্য, বিরোধীরা নির্বাচনে পরাজিত হতে চলেছেন জেনে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। বিজেপির মুখপাত্র নরসিমহা রাও বলেন, "বিরোধীরা নিজেদের পরাজয়কে অজুহাত দিয়ে ঢাকতে চাইছেন। এর আগে তাঁরা যখন জিতেছিলেন, তখন এতো প্রশ্ন তোলেন নি, কিন্তু এবার যখন তাঁদের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত, তখনই ইভিএম মেশিন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। যেভাবে তাঁরা নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় তুলছেন, তা গণতন্ত্রের অপমান ছাড়া আর কিছু নয়।"
আরও পড়ুন: ‘অহংকারী’ মমতার রাজ্যে উনিশের ভোটে কী কী বললেন মোদী?
নির্বাচন কমিশনের বৈঠকের আগেই নিজেদের মধ্যে বৈঠক সেরেছে সব বিরোধী দল। নিউ দিল্লির কন্সটিটিউশন ক্লাবে উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেসের গুলাম নবী আজাদ, আহমেদ প্যাটেল, টিডিপির চন্দ্রবাবু নাইডু, আপ-এর অরবিন্দ কেজরিওয়াল, টিএমসির ডেরেক ও'ব্রায়েন, সপার রাম গোপাল যাদব, বিএসপির সতীশ চন্দ্র মিশ্র, ডিএমকের কানিমোঝি, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই এর সুধাকর রেড্ডি এবং ডি রাজা, ও এনসিপির প্রফুল্ল প্যাটেলরা। ঘন্টাখানেক ধরে চলা এই বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সূত্রের খবর অনুযায়ী, ইভিএম মেশিন কারচুপিই হবে কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের মূল বিষয়। মিডিয়াকে প্রফুল্ল প্যাটেল বলেন, "ইভিএম মেশিনে কোনও অসঙ্গতি পেলে গণনা করতে হবে সব ভিভিপ্যাট স্লিপ, এবং ইভিএম মেশিন নিয়ে যেসব ভিডিও দেখতে পাওয়া গেছে, সেগুলির সত্যতা জানতে চাওয়া হবে কমিশনের কাছে।"
প্রসঙ্গত, বিরোধীরা যখন বিজেপির প্রতি নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে মুখর, সে সময়েই প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার দায় নির্বাচন কমিশনের উপর বর্তায় বলে মন্তব্য করেছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১৯-এর লোকসভা ভোট যথার্থ ভাবে সম্পাদনার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রশংসা করার পরের দিন প্রণব মুখোপাধ্যায় ইভিএমে কারচুপি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, “ভোটারদের মত নিয়ে কারচুপি করার ব্যাপারে যেসব অভিযোগ এসেছে তা নিয়ে আমি চিন্তিত। ইভিএমের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দায় নির্বাচন কমিশনের।”
Read the full story in English