Advertisment

এবারের ভোটে কংগ্রেসের ভুল ও রাহুল গান্ধীর দায়

বিজেপি ক্ষমতায় ফিরেছে আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে, বেশি ভোট পেয়ে। কংগ্রেসের বেশ কিছু গলদের সুযোগ নিয়েছে তারা। রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেসের সামনে এখন কঠিন খাড়াই পথ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
sonia gandhi, rahul gandhi, সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী

ফাইল ছবি

১) ১৮টি রাজ্যে ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে একটি আসনও পায়নি কংগ্রেস কেরালায় এবং দু অঙ্কে পৌঁছেছে।
২) উত্তর প্রদেশে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেস তাদের তুরুপের তাস বানিয়েছিল প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। সে রাজ্যে বিজেপির ভোট ৭.৫৩ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৬.৩১ শতাংশ। মোট ভোট ৬০.৬১ লাখ থেকে কমে হয়েছে ৫৪.৫৭ লক্ষ।
৩) ২০০৯ সালে উত্তর প্রদেশ থেকে ২২ টি আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। এবার সেগুলিতে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছিল। এবার এর মধ্যে ১৪টি আসনে ২০১৪ সালের থেকেও কম ভোট পেয়েছে তারা। এর মধ্যে রয়েছেন সলমন খুরশিদ, আরপিএন সিং, অন্নু ট্যান্ডন এবং জিতিন প্রসাদের মত ভারী নাম।
৪) মধ্য প্রদেশে পাঁচ মাস আগে কংগ্রেস ধরাশায়ী করেছে বিজেপিকে। এবারের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের ভোট ২০১৪-র থেকেও কমেছে। ভোটশেয়ার কমেছে কর্নাটকেও।
৫)  মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, এবং হিমাচল প্রদেশেও কংগ্রেসের ভোট শেয়ার কমেছে। এ রাজ্যগুলিতে সব মিলিয়ে ১১৫টি আসন রয়েছে।
৬) কয়েকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং উত্তরপূর্ব ও গোয়ার মত ছোট রাজ্যগুলি বাদ দিলে, পাঞ্জাব ও ছত্তিসগড়ে পার্টির ভোট শেয়ার ৪০ শতাংশ ছুঁয়েছে।

Advertisment

এই সংখ্যাগুলি দেখলেই বোঝা যাবে নরেন্দ্র মোদী ঢেউয়ের দ্বিতীয় পর্বের কাছে কতটা হার স্বীকার করতে হয়েছে তাদের।

Rahul Gandhi ফল ঘোষণার পর সাংবাদিক সম্মেলনে রাহুল গান্ধী (ছবি- অনিল শর্মা)

এই ফল মোদীজাদুর কাছে কড়া পরাজয়ের তত্ত্ব বলে বর্ণিত হলেও এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে গত পাঁচ বছরে বেশ কয়েকটি ভুল পদক্ষেপ, সাংগঠনিক অদক্ষতা, কৌশল ভুল বোঝা, পরিকল্পনায় গলদ এবং ভুল বার্তার ঘটনাও এ ফলের জন্য দায়ী। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দলের প্রধান হিসেবে যিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং মোদীর মুখোমুখি যাঁকে কংগ্রেস দলের মুখ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে সেই রাহুল গান্ধীকে এর দায়িত্ব নিতে হবে।

ফলে সবার নজর ছিল ২৫ মে-র কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের দিকে। রাহুল কি পদত্যাগ করবেন. নাকি তিনি প্রয়োজনীয় বদলগুলি ঘটাবেন যেমনটা তিনি দাবি করেছিলেন! তাঁর দাবি ছিল পার্টিতে কল্পনাতীত বদল আনার। ২০১৩ সালে দিল্লির ভোটে আম আদমি পার্টির হাতে ব্যাপক পরাজয়ের পর এমনটাই বলেছিলেন রাহুল। কিন্তু ওয়ার্কিং কমিটিতে যা ঘটল, তাতে কোনও চমক নেই। রাহুল পদত্যাগ করতে চাইলেন, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সে প্রস্তাব খারিজ করে দিল এবং রাহুলকে পার্টিকে ঢেলে সাজানোর এবং সমস্ত স্তরে পার্টির নবগঠনের।

আরও পড়ুন, লোকসভায় হারের গ্লানির মাঝেই মাওবাদী অধ্যুষিত বস্তারে জয় নিয়ে খুশি কংগ্রেস

২০১৪ সালেও এই একই চিত্রনাট্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। সোনিয়া এবং রাহুল পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁদের আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি। তখনও বদল ও পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতির কথা শোনা গিয়েছিল, কিন্তু কয়েকটি সাংগঠনিক বদল ছাড়া কংগ্রেসে রয়ে গিয়েছে কংগ্রেসেই।

বার্তায় গলদ

২০১৮ সালের গ্রীষ্মে সমস্ত সাংসদ, রাজনীতিবিদ, সংবাদকর্মীরা ব্যস্ত রাহুল গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীকে আলিঙ্গন নিয়ে আলোচনায সে সময়েই সংসদের দফতরে বলে এক বর্ষীয়ান নেতার পর্যবেক্ষণ ছিল কোনও আইডিয়া ততটাই ভাল যতটা ভাল তার প্রয়োগ।

তিনি বলছিলেন, "নিজের ঠাকুমা ও বাবাকে খুন হতে দেখেছেন এমন একজন যখন ঘৃণার ও ক্রোধের বিপরীতে ভালবাসার বার্তা দেন, তখন সে আইডিয়া অতীব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রয়োগকালে সে বার্তা হারিয়ে গেল। আমরা সবাই জানি বিজেপি, আরএসএস, এবং মোদী ঘৃণা ছড়াচ্ছেন কিন্তু এগিয়ে গিয়ে মোদীকে জড়িয়ে ধরার মধ্যে দিয়ে অবিশ্বাস্য সে বার্তার সিরিয়াসনেসটাই হারিয়ে গেল।" বহুআলোচিত আলিঙ্গনের কয়েকদিন পর বলছিলেন প্রাক্তন সেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।

সে ঘটনা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ওই নেতা বলছিলেন "আমাদের বার্তায় খুবই গলদ ছিল। সে তিন তালাকের মত বানিয়ে তোলা ইস্যুই হোক বা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা বালাকোট হামলার মত আবেগপ্রবণ ইস্যুই হোক... সব ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত আমরা জনসাধারণের মুড এবং সেন্টিমেন্টের বিপক্ষে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। শেষ তিন মাসের প্রচার দিয়ে নির্বাচন জেতা যায় কালেভদ্রে। আমরা সম্ভবত লড়াই শুরুর আগেই হেরে গিয়েছিলাম।"

কংগ্রেসের নেতারা বলছেন যুবসমাজ - যাঁরা পরিবারের মধ্যে মত তৈরি করে থাকেন - তাঁদের প্রতি দলের বার্তা ছিল জবড়জং। রাহুল বেকারত্ব ও খাদ্যের ইস্যু কথা বলতে পারেন কিন্তু অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতার ধারণা, মোদীর বেপরোয়া জাতীয়তাবাদী এবং হিন্দুত্বের প্রচারের সামনে তা ফিকে হয়ে গিয়েছিল। এর সঙ্গে ছিল পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ।

আরও পড়ুন, “দায়িত্বশীল বিরোধীর ভূমিকা পালন করবে কংগ্রেস”

আসামের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলছিলেন, "ভারতে আবেগ খুব বড় ভূমিকা নেয়। আমাদের সেটা বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী বদল ঘটনাতে হবে। আরেক প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলছিলেন, শুধু আবেগের ব্যাপার নয়। জিএসটি-কে গব্বর সিং ট্যাক্স বলে অভিহিত করে আমরা কী বার্তা দিয়েছি। সমস্ত কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও কংগ্রেস সভাপতি শেষ পর্যন্ত অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।"

ভিতেই ফাঁক

২০১৪ সালের হেরে যাওয়ার পর সোশাল মিডিয়ায় আসতে শুরু করেন কংগ্রেসের নেতারা। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ অনিচ্ছায়। অনেকেই সোশাল মিডিয়ার ক্ষমতার কথা মেনে নিয়েছেন। তবে সমালোচকরা বলছেন, অনেক কংগ্রেস নেতাই ভুলে গেছেন যে আসল গ্রাউন্ডওয়ার্কের বিকল্প সোশাল মিডিয়া হতে পারে না।

আইসিসির সাধারণ সম্পাদক এক প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক বললেন, "কমিউনিস্টরা মহারাষ্ট্রের মত জায়গায়, যেখানে তাদের প্রায় কোনও অস্তিত্বই নেই, সেখানে কিষাণ মার্চ করতে পারল। আমরী কী করছিলাম! অন্ধ্রের জগনমোহন কয়েক মাস ধরে রাস্তায় ছিলেন। রেজাল্ট দেখুন। ডিএমকে-র স্ট্যালিনও রাস্তায় নেমে কাজ করেছেন।"

এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, যিনি এখন আর দলের সুনজরে নেই, তাঁর কথায়, "কৃষিসমস্যা ছিল, দলিতদের মধ্যে বিক্ষোভ ছিল, ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল... আমাদের কোথাও দেখা যায়নি। প্রায় সব প্রদেশ সভাপতিরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়ে তার ছবি সোশাল মি়ডিয়ায় আপলোড করে, পরদিন সকাল হতেই খবরের কাগজের ক্লিপিং পাঠিয়ে দিচ্ছেন দিল্লিতে... এগুলো তো সত্যিকারের মানুষের জন্য আন্দোলন নয়।"

অনেক কংগ্রেস নেতাই অবাক হয়েছিলেন যখন রাহুল গান্ধী ৪৫ বছর বয়সী প্রথমবারের সাংসদ রাজীব সাতভের হাতে গুজরাটের দায়িত্ব তুলে দেন। এই হঠাৎ উত্থান নিয়ে ঈর্ষার বিষয় ছাড়াও অনেক বর্ষীয়ান নেতাদের মধ্যেই প্রশ্ন জেগেছিল মোদী-অমিত শাহের রাজ্যের দায়িত্ব তিনি সামলাতে পারবেন কিনা।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে উত্তর প্রদেশের দায়িত্ব দেওয়া বা হরিয়ানায় গুলাম নবি আজাদকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত ও এসবের সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বহু কংগ্রেস নেতা।

তিন রাজ্যেই ফল স্পষ্ট। হরিয়ানা এবং গুজরাটে কংগ্রেস একটি আসনও পায়নি। গুজরাট ও উত্তর প্রদেশে ভোটশেয়ার কমেছে। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে ভোট, দিল্লিতে ভোট পরের বছরের শুরুতে - রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসের সামনে সাংগঠনিক ভুলের কাহিনি।

কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রীদের কোনও সংযোগ ছিল না। নেতাদের বিবৃতি থেকে ভুল বার্তা গেছে। স্থানীয় ইস্যু নিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার বিবৃতি ভুল বার্তা দিয়েছে। গত এক বছরের মধ্যে তা সংশোধন করার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বললেন কর্নাটকের এক বর্ষীয়ান নেতা।

মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চৌহান দোষ দিচ্ছেন রাজ্য নেতৃত্বকে।

হরিয়ানার এক বর্ষীয়ান নেতা বললেন, "সে রাজ্যে কংগ্রেস জাঠপন্থী হবে নাকি জাঠ বিরোধী হবে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেনি।"

পাঞ্জাবের অমরিন্দর সিংয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল ভিন্ন। যে কোনও ইস্য়ুতে তিনি নিজের স্পষ্ট মত দিয়েছেন, তা হাইকম্যান্ডের সঙ্গে না মিললেও। অমরিন্দরের দীর্ঘদিনের বিরোধী এক কংগ্রেস নেতা বলছিলেন, উনি অন্তত বিজেপিকে জায়গা ছেড়ে দেননি।

Rahul Gandhi ওয়ার্কিং কমিটির সভা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন রাহুল গান্ধী (ছবি- তাশি তোবগিয়াল)

রাহুলের ভুল নেতৃত্ব?

রাহুলের কোর টিম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এক প্রবীণ নেতার কথায়, "২০১৪ সালেও এই টিমই নির্বাচনের দায়িত্বে ছিল, এবার নতুন সংযোজন বলতে ছিল কংগ্রেসে ডেটা অ্যানালিটিক্স টিমের প্রধান প্রবীণ চক্রবর্তী। ওরা রাহুলকে বলেছিল ৩ সপ্তাহে ওরা ১০ লক্ষ বুথ কমিটি তৈরি করেছে।"

"ওরা বলেছে ১০ দিনের মধ্যে সমস্ত বুথ কমিটিকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, ১কোটি ২০ লক্ষ মানুষকে শক্তি অ্যাপের মাধ্যমে সংগঠিত করা গেছে এবং প্রতি বুথে ১০ জন করে রয়েছে। তার মানে এক কোটিরও বেশি। কংগ্রেস সভাপতি যদি এতে বিশ্বাস করেন, আমাদের কী বলার আছে?"

"ডেটা অ্যানালিটিক্স টিম রাহুল এবং শীর্ষ কংগ্রেস নেতাদের বলে গেছে যে রাফাল ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ এবং ন্য়ায় প্রতিশ্রুতি প্রভূত আকর্ষণীয় হয়েছে।"

এই বিশাল ব্যর্থতা রাহুল ও তাঁর দলের কাছে পথের শেষ যদি না-ও হয়, তাহলেও সামনের রাস্তা খাড়া চড়াইয়ের। বিশেষ করে রাহুলের নেতৃত্বে এবং এমন এক রাজনীতির মাধ্যমে যে রাজনীতি তাঁকে এবং তাঁর পরিবার ঘিরেই আবর্তিত হয়।

Read the Full Story in English

CONGRESS rahul gandhi General Election 2019
Advertisment