এ এক অদ্ভুত মিক্সার-গ্রাইন্ডারে চড়ে বসেছি আমরা, যেখানে প্রত্যেকটা দেশ গুলিয়ে রয়েছে, কীভাবে এই রোগ, এই অতিমারিকে সামলাবে। অর্থনীতি গুলিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে কাটবে এই লকডাউন পরবর্তী অর্থনৈতিক দুরবস্থা? গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্য পরিষেবা গুলিয়ে যাচ্ছে। এই রোগের প্রকোপ থেকে এই মানব সভ্যতা আদৌ বেঁচে উঠতে পারবে তো?
মধ্যবিত্তের কাছে গুলিয়ে যাচ্ছে, এই মহামারী ও লকডাউন পরবর্তী জীবনে কতটা স্বাচ্ছন্দ্য থাকবে। নিম্নবিত্তের কাছে গুলিয়ে যাচ্ছে রোজগারের প্রশ্ন আবার ধর্ম গুলিয়ে যাচ্ছে তার হাজার বছরের বিশ্বাসে। আসলে এই ভাইরাসের আক্রমণের পর থেকে এই যে গুলিয়ে যাওয়া, ঘোলা বিষয়গুলো চোখের সামনে বার বার করে উঠে আসছে, সেগুলোর বীজ কিন্তু অনেক আগে থেকেই বপন করা শুরু হয়েছে। হয়তো সবকিছু গুলিয়ে দিতেই চাওয়া হচ্ছিল এক সুপরিকল্পনায়।
আরও পড়ুন: গরিব বাঁচলেই শুভ হয়ে উঠবে নববর্ষের এবারের রূপ
সেজন্যেই তো সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের পাশে গজিয়ে ওঠা কঠিন নামের ক্যাফেগুলো আমার না যেতে পারা জর্জিয়ার স্বাদ মেটায় কিংবা গুরগাঁওয়ের আইটি পার্ক মেটায় ইজরায়েলের সিলিকন ভ্যালি হতে চাওয়ার লোভ। তপসিয়ার বস্তি থেকে দেখতে পাওয়া শহরের উচ্চতম ইমারত-- গরিবের বুর্জ-খলিফা-ঘোল হয়ে লড়ে চলে দুধের স্বাদ মেটানোর চেষ্টায়। এভাবেই আমার সাজপোশাক, অভ্যাস, লোভ আমাকেই গুলিয়ে দেয়। আর চোখের সামনে দিয়েই কখন তারা প্রথম বিশ্বের মতো হয়ে ওঠে তা জানতেও পারি না। আসলে, গুলিয়ে দিতে চাওয়া হয় কারণ তাতে আরও সরল বড় বাজার তৈরি করা যায়। যদি আমার এবং আপনার চাহিদাগুলো মৌলিক থাকে তাহলে তো কখনোই সার্বিক ব্যবসা করা যায় না। নাহলে গত দুই দশকে এই 'ইনভেস্টর' নামক শব্দটি এত চর্চায় চলে আসে কী করে? আর কেন তারা সবাই একটা শ্রেণির হয়? আর হারাধনের হারিয়ে যাওয়া আমরা ইলুমিনেতি-র গল্প পড়তে পড়তে কখন যেন নেশাতুর চোখে আমাদের স্বকীয়তা ছেড়ে রাষ্ট্র কারখানার কনভেয়ার বেল্টে বসে এগিয়ে যাওয়াটাকে নিজের অ্যাচিভমেন্ট বলে কলার তুলি-- ও আপনি ধরতে পারবেন না।
আরও পড়ুন: নববর্ষের বিকেলেই মুক্তি পাচ্ছে ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে’
আসল সমস্যাটা বোধহয় আমরা কেউই আর এই 'আমরা'-টা হতে চাই না, 'একটা কিছুর মতন' হতে চাই। যেভাবে আমার শহর হতে চায় অন্য শহর, ক্রিম মেখে ফরসা হতে চায় কালো ত্বক। মধ্যবিত্ত সরস্বতীকে সাইড করে বাঙালি ডাকতে চায় বড়লোক গণপতি বাপ্পাকে। আর কী সুমসৃণভাবে কোনও এক হ্যালোউইন বা থ্যাঙ্কসগিভিং টুপ করে গিলে ফেলে বাঙালির নববর্ষকে। তবে খাতায় কলমে সে যতই প্রয়োজনহীন হোক, যতই এড়িয়ে যাক শহরের নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, খাতা খোলার সঙ্গে যার সম্পর্ক, তার পাট অত তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলাও যে সম্ভব না। নিতাই কাকুর শাড়ির দোকান হোক কিংবা রহমান চাচার মুদিখানা, ধর্মের ঊর্ধ্বে যে উৎসব, তার তো প্রয়োজন আরও বেশি, বিশেষ করে এই অস্থির সময়ে।
১০০ বছর আগের প্যানডেমিকের ইতিহাস যদি করোনা ফিরিয়ে আনতে পারে, নববর্ষের আবেগ যে আরও বেশি করে বাঙালিকে সুড়সুড়ি দেবে না কে বলতে পারে। বাঙালির এই মেহনতী মানুষের গন্ধ লেগে থাকা পার্বণ তো নতুন শুরুর কথা বলে। তবে হোক না নতুন শুরু। লকডাউন তো আর মনের হয় না... বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গুলিয়ে দেওয়া শক্তিগুলো যখন নিজেরাই খরার মরসুম কাটাচ্ছে, বাঙালির আবেগের ছোট নদীতে না হয় বৈশাখ মাসের হাঁটু জল থাক।