Advertisment

নবমীতে কাদামাটি আর ঠাকুরদালানে নাটক! সুজন মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজোর গল্প

Sujan Mukherjee: হাওড়া শিবপুরের বিখ্যাত ডাক্তারবাড়ির ছেলে সুজন মুখোপাধ্যায়। বাইরের কোনও পুরোহিত নয়, পুজো করেন পরিবারের সদস্যরাই। ছোটবেলার ও বড়বেলার পুজোর গল্প শোনালেন অভিনেতা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Actor Sujan Mukherjee shares memories of his ancestral home Shibpur Daktar Barir pujo

সুজন (নীল) মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজোর ছবি সৌজন্য: সুতর্ষা দত্ত

Shibpur Daktar Barir Pujo: বাংলা থিয়েটারের স্বনামধন্য পরিচালক অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে সুজন মুখোপাধ্যায় সর্বত্র নীল মুখোপাধ্যায় নামেই বেশি পরিচিত। তিনি ও তাঁর দাদা, পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় (লাল) ছোটবেলায় বেশ কিছু বছর কাটিয়েছেন তাঁদের শিবপুরের বাড়িতে, যা এই অঞ্চলে ডাক্তারবাড়ি নামেই পরিচিত। শিবপুরের এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের পূর্বতন প্রজন্মের বহু সদস্যই ছিলেন চিকিৎসক এবং তাঁরা এলাকার দরিদ্র মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা করতেন। সেই থেকেই এই বনেদি বাড়ির নাম হয়ে গিয়েছে ডাক্তারবাড়ি। বর্তমান প্রজন্মেরও অনেকে চিকিৎসকের পেশাকে বেছে নিয়েছেন। এই বনেদি পরিবারের পুজো ডাক্তারবাড়ির পুজো বলেই বিখ্যাত শিবপুর অঞ্চলে।

Advertisment

''আমাদের বাড়ির এই পুজো সব দিক থেকেই ঘরোয়া। পুজোর কটাদিন রান্নার জন্য শুধু একজন ঠাকুর আসেন। বাকি সব আয়োজনই করেন পরিবারের সবাই। এমনকী পুজোও করেন আমাদের পরিবারেরই একজন। বাইরে থেকে কোনও পুরোহিত আসেন না'', বলেন নীল মুখোপাধ্যায়, ''ওই বাড়িতে আমার খুব কম সময়ই থাকা হয়েছে। কারণ বাবা কাজের সুবিধার জন্য কলকাতায় যখন চলে আসেন, তখন বোধহয় আমার ৫-৬ বছর বয়স। দাদা আরও একটু বেশি সময় কাটিয়েছে। একটা সময় পরে বাবার অংশটি বিক্রি করে ফ্ল্যাট উঠেছে কিন্তু তার পরেও পুজোতে আমরা মোটামুটি যেতাম নিয়মিত অষ্টমী বা নবমীতে।''

আরও পড়ুন: মিত্র বাড়ির বউ সঙঘশ্রী! শোনালেন ৩৭২ বছরের পুজোর গল্প

এই বাড়িতে পুজো হয় বৈষ্ণবমতে। সন্ধিপুজো থেকে সিঁদুরখেলা, সব আচারই রয়েছে। আর নবমীতে কাদামাটি খেলা একটি প্রধান আকর্ষণ বলা যায়। বাংলার বেশ কিছু অঞ্চলের বনেদি পরিবারগুলির মধ্যে নবমীর সকালের এই প্রথাটি রয়েছে। পরিবারের সমস্ত পুরুষ সদস্যরা, আট থেকে আশি, প্রায় দোলখেলার মতো করেই পরস্পরের গায়ে কাদা মাখিয়ে দেন, কখনও কখনও কুস্তিও লড়েন। তার পরে সদলবলে পরিক্রমাতে বেরতে হয়, সঙ্গে থাকে ঢাকের বাদ্যি। শিবপুর ডাক্তারবাড়ি থেকে বেরিয়ে কাদামাটি খেলুড়েদের দল মন্দিরতলা মোড় ছুঁয়ে যেত শিবপুর বাজারের কাছে বড়ঘড়ির মোড় পর্যন্ত। তার পরে বাড়ি এসে স্নান। আগে নিয়ম ছিল কাদামাটি খেলে গঙ্গায় স্নান করে বাড়ি ফেরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা বদলেছে।

Suman Mukherjee, Arun Mukherjee, Sujan Mukherjee and his son তিন প্রজন্ম: বাঁদিক থেকে সুমন মুখোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়, সুজন মুখোপাধ্যায় ও সুজন মুখোপাধ্যায়ের ছেলে।

নীল মুখোপাধ্যায় জানালেন, তাঁর ছোটবেলায় পুজোতে এই কাদামাটি খেলার স্মৃতিটা বেশ তাজা। এখনও বেশিরভাগ নবমীতেই শিবপুরের বাড়িতে সপরিবারে যান অভিনেতা কিন্তু খেলাটা আর হয় না। ''নবমীর সকালে গিয়ে আমরা সাধারণত লাঞ্চ করে ফিরতাম। পাঁচ-ছবছর আগে আমি আর দাদা একসঙ্গে গিয়েছিলাম মনে আছে। সেটাও আবার অনেক বছর পরে যাওয়া। সেদিন গিয়ে দেখি নবমী-দশমী একসঙ্গে পড়েছে। আর আমাদের বাড়ির পুজোর ভাসান বিকেলের মধ্যে হয়ে যায়। আমরা সেবার খেয়ে উঠতে উঠতেই দেখি তাসা পার্টি এসেছে। সেবার অনেক বছর পরে ভাসানে নেচেছিলাম... সে উদ্দাম নাচ'', হাসতে হাসতে বলেন অভিনেতা।

আরও পড়ুন: শোভাবাজার রাজবাড়ির জামাই পদ্মনাভ, শোনালেন ও বাড়ির পুজোর গল্প

নীল মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়ও অভিনেত্রী। থিয়েটার দিয়ে শুরু, পরে বড়পর্দায় এবং বিগত কয়েক বছর ধরে টেলিপর্দায় অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেত্রী তিনি। কৃষ্ণকলি ধারাবাহিকে শ্যামার শাশুড়ি হিসেবেই টেলিদর্শক তাঁকে মূলত চেনেন। আর যাঁরা নিয়মতি বাংলা থিয়েটার দেখেন, তাঁরা জানেন চেতনা-র ডন অথবা ঘাসিরাম কোতোয়াল-এ কী অসামান্য তাঁর পারফরম্যান্স। ১৯৯৮ সালে বিয়ে হয় নীল ও নিবেদিতার। মিলেনিয়ামের গোড়াতে দুবছর তাঁরা সংসার করেছেন শিবপুরে তাঁদের নিজস্ব ফ্ল্যাটে। সেই দুর্গাপুজোর বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছিল বাড়ির পুজোতেই, জানালেন নীল। তার পরে আবারও কাজের সুবিধার জন্য কলকাতায় থাকতে শুরু করা এবং প্রতি বছর একটি দিন যাওয়া, এই ভাবেই পরিবারের পুজোর সঙ্গ জুড়ে থাকা। যেহেতু পুজোতে অনেক সময়েই নাটকের শো থাকে, তাই সব সময় চাইলেও যাওয়া হয়ে ওঠে না।

Sujan Mukherjee in Debi Choudhurani and Nibedita Mukherjee in Krishnakoli 'দেবী চৌধুরাণী' ধারাবাহিকের লুকে নীল এবং 'কৃষ্ণকলি' ধারাবাহিকের লুকে নিবেদিতা।

নাটকের ট্রাডিশন এই পরিবারের রক্তে। এই মুখোপাধ্যায় পরিবারে বহু প্রজন্ম ধরেই একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশ রয়েছে। বাংলার অভিজাত পরিবারগুলির মধ্যে ঠাকুরবাড়িই ছিল অগ্রণী, যেখানে প্রথম ঠাকুরদালানে নাটকের চল শুরু হয়। পরবর্তীকালে বাংলার বহু বনেদি পরিবারেই শারদোৎসবের অঙ্গ হিসেবে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রেওয়াজ তৈরি হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে শিবপুরের ডাক্তারবাড়িতেও শুরু হয় ঠাকুরদালানের অনুষ্ঠান। বিজয়া সম্মিলনীই কিন্তু অনুষ্ঠানটা হতো লক্ষ্মীপুজোর দিনে।

আরও পড়ুন: জন্মদিনেই কুমারী রূপে পূজিত খুদে টেলি-তারকা

বাড়ির সদস্যরাই রিহার্সাল দিতেন, অনুষ্ঠান করতেন। বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব এবং নীলের বাবা অরুণ মুখোপাধ্যায় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের একজন পুরোধা। ঠাকুরদালানের অনুষ্ঠানেও তাঁর ব্যক্তিত্বের সেই দিকটি ধরা পড়ত। নীল মুখোপাধ্যায় জানালেন, কৈশোরে এবং যৌবনে পুজোর পরের ওই পারিবারিক সম্মিলনীতে বহুবার নাটক করেছেন, কখনও নিজের পরিচালনায়, কখনও অরুণ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়।

Actor Sujan Mukherjee shares memories of his ancestral home Shibpur Daktar Barir pujo শিবপুর ডাক্তারবাড়ির পুজো। ছবি সৌজন্য: সুতর্ষা দত্ত

''ওই ঠাকুরদালানে আমার প্রথম নাটকের কথা এখনও মনে আছে। বাবা একটা চাইনিজ ফেবল থেকে ছোট্ট একটা নাটক লিখেছিল। বাবা হয়েছিল গ্রামের খুব গরিব একজন মানুষ আর আমি তার ছেলে। তার বাড়িতেই চোর ঢুকবে চাল চুরি করতে। চোরটা হয়েছিল দাদা। আমার সংলাপ কিছুই ছিল না। শুধু ছেলেটা মাঝেমধ্যেই ঘুম থেকে কিত কিত বলতে বলতে উঠে পড়ে আর তার বাবা তাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তার পরে একবার চেতনা-র একটি নাটক, ভূতের বরে, সেটাও হয়েছিল ঠাকুরদালানে, আমার পরিচালনায়'', বলেন নীল।

আরও পড়ুন: মনে আছে নতুন জুতোটা নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম: জয়জিৎ

ঠাকুরদালানে বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠানে একবার খুব মজার একটা ঘটনা ঘটে, নীল মুখোপাধ্যায়ের জন্মের আগে। তখন অরুণ মুখোপাধ্যায় নিতান্তই তরুণ। ঘটনাটি তাঁর মুখেই শুনেছিলেন নীল। ঘরোয়া অনুষ্ঠান মূলত নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলেই হয়। নিজেদের বাড়ির টুকটাক আসবাব, জিনিসপত্র দিয়ে মঞ্চ সাজানো হতো। একবার বাড়িরই এক সদস্যের বেডকভার নিয়ে নাটকের জন্য মঞ্চ সাজানো হয়। সেকথা তাঁকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেওয়া হয়নি। নাটকটি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন যে তাঁর ঘর থেকেই চুপিসারে সরানো হয়েছে বিছানার চাদর। তিনি তখন নাটক চলাকালীনই রেগেমেগে বেডকভারটি খুলে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন।

''আমাদের বাড়ির পুজোতে খুব বেশি জাঁকজমক, ধুমধাম ছিল না কখনও। আমাদের ঠাকুরদালানও যে বিশাল বড় তা নয়। কিন্তু খুব নিষ্ঠাভরে পুজো হতো, এখনও হয়, নিজেদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই। আর পরিবারের সবাই খুব আনন্দ করে কাটান এই কয়েকটা দিন, সেটাই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে'', বলেন নীল মুখোপাধ্যায়।

Bengali Serial Bengali Television Durga Puja 2019 Bengali Actor
Advertisment