Darzipara Mitra Barir Pujo: সঙ্ঘশ্রী সিনহা মিত্র শ্বশুরবাড়ির পুজো বললে একটু রেগেই যান। তাঁর কাছে এটা তো বাড়ির পুজো, শ্বশুরবাড়ি কেনই বা বলা হবে। শোভাবাজারের মিত্র বাড়ির বউমা, সঙ্ঘশ্রী ছোটপর্দা ও বড়পর্দা দুই মাধ্যমেই অভিনয় করছেন বিগত সাত-আট বছর ধরে। তবে শুধু অভিনয় নয়, এগজিকিউটিভ প্রোডিউসারের দায়িত্বও সামলেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮-তে বিয়ে হয়ে আসেন মিত্র বাড়িতে। তাঁর বাড়ির পুজোর খুঁটিনাটি, পুজোর আচার ও চারদিনের মেনু জানালেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে।
''আমাদের মিত্র বাড়ির পুজো এবছর ৩৭৩ বছরে পা দেবে। আমাদের বংশে মা দুর্গার নিত্যপুজো হয় গোপাল ও রাধাকৃষ্ণের সঙ্গে। আর প্রতি বছর শারদোৎসবে প্রতিমা এনে পুজো করা হয়। এই পুজোয় কোনও চাঁদা তোলা হয় না। দেবত্র সম্পত্তি থেকে পুজো হয়। পুজোটা শুরু হয়েছিল জোড়াসাঁকো-তে, তার পরে নীলমণি মিত্র ও দুর্গাচরণ মিত্র শোভাবাজারের দর্জিপাড়ায় চলে এলে এখানকার ঠাকুরদালানে নতুন করে পুজো শুরু হয়'', বলেন সঙ্ঘশ্রী, ''এখন সবাই দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ির পুজো বলেই জানেন আমাদের বাড়ির পুজোকে।''
আরও পড়ুন: ‘মা দুর্গা’ রূপে আসছেন মধুমিতা, কে হলেন মহাদেব?
এই বাড়িতে পুজো হয় বৈষ্ণব মতে, তাই পিতৃপক্ষের তর্পণের পর থেকে দশমীতে ঠাকুর ভাসান পর্যন্ত বাড়িতে পেঁয়াজ, রসুন, মাছ-মাংস, ডিম ঢোকা বারণ। আবার কচু, চালকুমড়ো, কাঁঠাল এগুলোও খাওয়া বারণ। তাই এই পুজোতে নবমীতেও ভোগ হয় নিরামিষ। আগে এবাড়ির পুজোতে মহিষ বলি হতো কিন্তু ১০০ বছর আগে পরিবারের কোনও সদস্য স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর থেকে পশুবলি বন্ধ হয়ে যায়।
''এই বাড়ির পুজোতে শুনেছি একবার লর্ড কর্নওয়ালিস এসেছিলেন। আর মা সারদা আমাদের বাড়ির পুজোর জন্য পরমান্ন রেঁধেছেন বলেও শুনেছি'', সঙ্ঘশ্রী জানান, ''এক সময়ে গম্ভীরা গান থেকে ছৌ নাচ, সবই হতো বাড়ির উঠোনে। আজও একান্নটা ঢাকের আরতি করতে হয় ঠাকুরকে। আর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী বাড়িতে প্রায় ২০০ জনের খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। ঠাকুরকে যা ভোগ দেওয়া হয়, সেটাই খাওয়া হয়।''
সঙ্ঘশ্রী জানালেন পরমান্ন হল আসল ভোগ আর খিচুড়ি-তরকারি হল উচ্ছিষ্ট। ঠাকুর ইচ্ছে করলে খাবেন, নাও খেতে পারেন। ষষ্ঠীতে সাবুর পায়েস, সপ্তমীতে আটার হালুয়া, অষ্টমী ও নবমীতে পায়েস, ও দশমীর দিন মিষ্টি দই দিয়ে খই মাখা-- এই হল ঠাকুরের প্রধান খাওয়া। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে থাকে পুজোর দিনে সাধারণের ভোজের আয়োজন। সপ্তমীতে লুচি-তরকারি-আটার হালুয়া। অষ্টমীতে খিচুড়ি ভোগ, লাবড়ার তরকারি, বেগুনি, চাটনি-পায়েস। নবমীতে পোলাও-নবরত্ন তরকারি, আলুর দম। আর এই তিন দিনে কোনও রকম ডাল রান্না হয় না। ঠাকুর বিসর্জনের পরে বাড়ির সবাই মাছ খেয়ে নিরামিষ ব্রতভঙ্গ করেন।
''মা দুর্গা তো বাড়ির মেয়ে, তাকে বরণ করে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে হয় আলো থাকতে থাকতে। এটা প্রায় সব ঘটিবাড়িরই নিয়ম। বাঙালবাড়িতে সাধারণত সন্ধ্যা নামার পরে বিসর্জন হয়। আর আমাদের বাড়ির নিয়ম হল ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে ফেরার সময় জোড়া মাছ, তেল-হলুদ কিনে আনতে হবে। উঠোনে সেই জোড়া মাছ পুজো করে মাছের ঝোল রান্না হবে। দশমীর রাতে ওই মাছের ঝোল খেয়ে আমাদের নদিনের নিরামিষ ব্রত শেষ হয়'', বলেন সঙ্ঘশ্রী।
আরও পড়ুন: মহিষাসুরমর্দিনী রূপে ছোটপর্দায় ফের দিতিপ্রিয়া!
জানা গেল, দশমীর দিনের পরে আবার ইলিশ মাছ খাওয়া যায় সরস্বতী পুজোর পরে। তবে এই বনেদি বাড়ির পুজোয় ঠাকুরকে কোন বাসনে খেতে দেওয়া হবে, তারও কিছু নিয়ম আছে। পঞ্চমীর বাসনে পুজো হয় আবার সপ্তমীতে, ষষ্ঠীর বাসনে পুজো হবে আবার দশমীতে। অষ্টমীর দিনের জন্য রয়েছে আলাদা নির্দিষ্ট বাসন আর নবমীতে ঠাকুরকে ভোগ দেওয়া হয় কলাপাতায়। বৃহৎ মিত্র পরিবার এখন অনেক ক্ষুদ্র ইউনিটে বিভক্ত, তাই এক এক বছর এক একজনের পালা পড়ে সব আয়োজনের। তবে পরিবারের সবাই হাসিমুখে এসে সাহায্য করেন পুজোতে।
''পুজোবাড়িতে অনেক কাজ থাকে, অতিথিদের চা-কফি-লস্যি সবকিছু দেওয়ার ঠিকঠাক ব্যবস্থা হচ্ছে কি না, সেটা দেখা। পুরোহিত মশাই পুজোর কদিন বাড়িতেই থাকেন। তাঁর প্রয়োজনের সবকিছু ঠিক সময়ে আয়োজন করা, ভোরবেলা ফুলের অর্ডার দিতে যাওয়া, আর তাছাড়া পুজোর বাকি জোগাড় তো রয়েছেই। ১০৮টা পদ্ম, ১০৮টা দূর্বা, ১০৮টা পানসুপারি, ১০৮টা বিল্বপত্র-- সব কিছু বেছে, গুছিয়ে রাখতে অনেকটা সময় লাগে। কিন্তু এই কোনও কাজকেই ঠিক কাজ বলে মনে হয় না। এই উৎসবের মধ্যে যে আনন্দ থাকে, তার সঙ্গে অন্য কোনও আনন্দের তুলনা চলে না'', বলেন সঙ্ঘশ্রী।