সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা। দে দে পেয়ার দে ছবির ট্রেলার লঞ্চের সময়ে বলিউড তারকা অজয় দেবগণকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ধর্ষণে অভিযুক্ত অলোক নাথের এ ছবিতে কাজ করা নিয়ে তিনি কী বোধ করছেন। অজয় দেবগণের উত্তর ছিল, ”এটা এ নিয়ে কথা বলার জায়গা নয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ যখন উঠেছে, তখন ছবির কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে।”
চলে আসা যাক বৃহস্পতি সন্ধ্যায়। একটি দীর্ঘ বিবৃতি প্রকাশ করেছেন অজয়। সেখানে বেশ কয়েকজায়গায় অলোক নাথের নামোল্লেখ করেছেন এবং নিজের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করেছেন। ১৭ দিনে কী এমন ঘটল? বিরোধিতা। অলোকনাথের বিরুদ্ধে যিনি অভিযোগ এনেছিলেন, সেই লেখক-প্রযোজক বিনতা নন্দা এ ছবির নির্মাতাদের তুলোধোনা করে বলেছেন, বক্স অফিসের কথা এলেই এখানে আর কারও কোনও ধর্মবোধ থাকে না। কোনও ঠিক ভুলের হিসেব থাকে না। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই অজয় দেবগণের নাতিদীর্ঘ রচনাটি প্রকাশিত হয়। সেখানে অজয় মূলত বলতে চেয়েছেন, এ ব্যাপারে কেন তাঁকে দোষী ঠাওরানো উচিত নয়।
আরও পড়ুন, আবার বিস্ফোরক তনুশ্রী, অভিযোগের তির এবার অজয়ের দিকে
বিনতাই অবশ্য প্রথম নন। সোশাল মিডিয়ায় লোকজন এ নিয়ে অজয় দেবগণকে সমালোচনা করেছেন এবং অলোক নাথের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে স্বীকৃতি না দেওয়া ও তাঁর সঙ্গে কাজ করার ঘটনার নিন্দাও করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছবি মুক্তির আগে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে নেমে অজয় দেবগণ যে বিবৃতি দিয়েছেন, তাতেও অলোক নাথকে নিন্দা করে একটি অক্ষরও খরচ করেননি।
অভিযোগ ওঠার আগেই যে এ ছবির কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, এ তথ্য সকলেরই জানা। তাঁর বিবৃতিতে অজয় দেবগণ ব্যাখ্যা করেছেন, অলোক নাথের অংশ, যা শুট করতে ৪০ দিন সময় লেগেছিল, তা ফের শুট করতে হলে প্রযোজক ভূষণ কুমার, অঙ্কুর গর্গ এবং লাভ রঞ্জনের অনেক খরচ হয়ে যেত। প্রশ্ন হল, বিবৃতিতে মিটু আন্দোলনের প্রতি তাঁদের যে সংবেদনশীলতার কথা অজয় দেবগণ উল্লেখ করেছেন তা যথার্থ হলে, তাঁদের কি নৈতিকতাকে অর্থের আগে জায়গা দেওয়া উচিত ছিল না? তেমনটা যদি হত তাহলে অজয় দেবগণের প্রকাশিত বিবৃতির চাইতে সেটা অনেক ভাল বিবৃতি হত।
বলিউড যেভাবে মি টু আন্দোলনের ব্যাপারে হলিউডের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল, তেমন ভাবে দে দে পেয়ার দে ছবির টিম কি এ ব্যাপারে হলিউডের রিডলে স্কটের মত ভূমিকা নিতে পারত না? ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে অল দ্য মানি ইন দ্য ওয়ার্লড ছবি মুক্তির কয়েক সপ্তাহ মাত্র আগে কেভিন স্পেসিকে ছবি থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন পরিচালক রিডলে স্কট। তখন ছবির ট্রেলারও মুক্তি পেয়ে গিয়েছে। স্কট তাঁর সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে গার্ডিয়ানকে বলেন, আমার সিদ্ধান্ত ছিল প্রায় তাৎক্ষণিক। আমি বলেছিলাম, আমাদের রি ডু করতে হবে। এমনকি বিষয়টিকে তিনি ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত হিসেবেও উল্লেখ করেছিলেন, কারণ এ ধরনের অভিযোগ ছবির উপর যে প্রভাব ফেলতে পারে সে কথা বুঝেছিলেন তিনি।
টি সিরিজ এ ইন্ডাস্ট্রিতে অত্যন্ত ক্ষমতাধর প্রোডাকশন হাউজ। তা সত্ত্বেও যদি মেনে নেওয়া হয় যে অর্থনৈতিক কারণে অলোক নাথকে ছবি থেকে বাদ দেওয়া কঠিন ছিল, সে ক্ষেত্রে কি ছবির প্রমোশনের আগে কমল নাথকে নিন্দা করে বিনতা নন্দা এবং তাঁর মত আরও মহিলাদের সমর্থন জোগানো যেত না? ফিল্মের ট্রেলার লঞ্চে এ ব্যাপারে যদি অজয় দেবগণ কথা বলতেন তাতে তাঁর কতটুকু মূল্যবান সময় ব্যয় হত? ছবির ট্রেলার ও গানের এত লিংক টুইটে শেয়ার করার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য তাঁর কটা টুইট ব্যয় হত? যথেষ্ট সুযোগ ছিল, এবং প্রতিবারই বলিউডের এই তারকা নিজের পছন্দ বেছেই নিয়েছেন।
এক মুহূর্ত সময় নিয়ে ভাবা যাক। দে দে পেয়ার দে প্রযোজক লাভ রঞ্জন নিজে গত বছর অক্টোবরে যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত হন। এ ব্যাপারে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেছিলেন, ”যাঁকেই আমি আহত করে থাকি না কেন, যাঁকেই আমি যথেষ্ট সহজ হওয়ার সুযোগ দিইনি, তাঁর কাছে আমি ক্ষমা চাইছি। আমার উদ্দেশ্য কী ছিল তা বোঝাতে না পারার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। আমি যা হতে চেয়েছিলাম, এবং আমি যা হতে চেয়েছি, তা বোঝাতে না পারার জন্য় আমি ক্ষমা চাইছি। আমি যা হতে চেয়েছিলাম, এবং যা হতে পেরেছি বলে আমার বিশ্বাস, আমি যে তেমনই একজন মানুষ, সে কথা বোঝাতে পারিনি বলে আমি ক্ষমা চাইছি।” অজয় দেবগণ খুব তাড়াতাড়িই লাভ রঞ্জন পরিচালিত ছবিতে অভিনয় করতে চলেছেন, প্রত্যাশিত ভাবেই তিনি এ নিয়ে মুখ খোলেননি। মিটু আন্দোলন যখন বলিউডে সাড়া ফেলেছে, তখন সৎ সাজার অভিপ্রায়ে অজয় দেবগণ টুইট করেছিলেন, ”যদি কোনও একজনও কোনও মহিলার সঙ্গে খারাপ কিছু করে থাকেন, তাহলে অজয় দেবগণ ফিল্মস বা আমি তা সহ্য করব না।”
বলিউডের অভিনেতারা নিজেদের সুবিধে মতন যেভাবে পদক্ষেপ করে তা দেখে মজাই লাগে। নিজের বিবৃতিতে অজয় দেবগণ বলেছেন, অলোক নাথকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি নিজে নিতে পারতেন না, কারণ ছবি তৈরি একটা যৌথ প্রক্রিয়া। ওঁকে জিজ্ঞাসা করা উচিত নিজের পছন্দমত পরিচালক নিয়োগ, পছন্দসই সহ অভিনেতা নিয়োগ, এবং নিজেদের উপকারে লাগবে এমন চিত্রনাট্য বাছাই করার ব্যাপারে তারকাদের যে ক্ষমতা, তা কি এক্ষেত্রে উবে গিয়েছিল! দে দে পেয়ার দে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ১৫ মার্চ, অজয় দেবগণের টোটাল ধামালের সঙ্গেই। সংঘর্ষ এড়াতে পেয়ার দে-র মুক্তি মে মাস পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। হ্য়াঁ ছবি তৈরি যৌথ প্রক্রিয়া, যখন বক্স অফিসের সংখ্যা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়, আর তিনি প্রযোজকদের হাতের পুতুল বলে অজয় দেবগণ যে দাবি করেছেন, তা তাঁর কমেডির চেয়েও বেশি হাস্যকর হয়েছে।
অজয় দেবগণের এই কান্নাভরা কাহিনির পূর্ববর্তী যেসব ফাঁক ফোকর, সেগুলো উপেক্ষা করা যেত, যদি অন্তত একটিবার তিনি তাঁর বিবৃতিতে অলোক নাথের নিন্দা করতেন। কিন্তু তাঁকে এ নিয়ে আক্রমণ করায় তিনি যে কতটা আহত হয়েছেন, আমি সর্বস্ব এই বক্তব্য়ের মধ্যে দিয়ে নিজের পছন্দ আরও একবার বেছে নিয়েছেন তিনি।
আহত হওয়া এবং আহত করা বলিউডের বলবানদের অধিকার। বাকি যারা, তাদের প্রায় কিছুই বলার থাকে না, ”মি টু” ছাড়া।
Read the Story in English