Advertisment

'আয়নার সামনে দাঁড়ালে পারফেক্ট, আমাকে নিজেকে লুকোতে হয় না', অকপট অপরাজিতা

'কারও ভাল কাজ দেখলে কেঁদে ফেলি, কেউ খুব ভাল কবিতা বলছে, আমি কেঁদে ফেলি... কিন্তু ধরো কাউকে সান্ত্বনা দিতে হবে বা মনের জোর দিতে হবে, সেখানে আমি আবার খুব স্ট্রং।'

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Aparajita Adhya exclusive on personal life

ছবি: শশী ঘোষ (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)

Aparajita Adhya exclusive interview: পর্দার অভিনেত্রীর সঙ্গে বাস্তবের মানুষটার মিল ও অমিল কতটা, খানিকটা সেই কৌতূহল থেকেই এই আলাপচারিতার সূত্রপাত। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে অপরাজিতা আঢ্য জানালেন তাঁর মায়ের কথা, দিদিমার কথা, স্বামীর কথা। যে পরিবারে তিনি বড় হয়েছেন বলা যায়, সেই শ্বশুরবাড়ি ও বিশেষ করে শাশুড়ি মায়ের কথায় জমে উঠল আলাপ।

Advertisment

আপনি যদি নিজেকে এককথায় প্রকাশ করেন তবে সেটা ঠিক কী রকম হবে? মানে আপনার কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি স্ট্রং?

আমার কনফেস করার ক্ষমতা। আমি আয়নার সামনে দাঁড়ালে পারফেক্ট। আমাকে নিজেকে লুকোতে হয় না।

আপনি খুব ইমোশনাল, তাই না?

ইমোশনাল পরিস্থিতি বিশেষে। আমি কেমন ইমোশনাল জানো তো, কারও ভাল কাজ দেখলে কেঁদে ফেলি, কেউ খুব ভাল কবিতা বলছে, আমি কেঁদে ফেলি। খুব ভাল গান, খুব ভাল কোনও সিন হচ্ছে... আমি যে এই কথাটা তোমাকে বলছি, এটাতেও কান্নার একটা অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু ধরো কেউ মারা গিয়েছে, কাউকে সান্ত্বনা দিতে হবে বা মনের জোর দিতে হবে, সেখানে আমি আবার খুব স্ট্রং।

সেজন্যেই কি অপরাজিতা আঢ্য আনব্রেকেবল, তাঁকে ভাঙা যায় না?

আনব্রেকেবল নই, অ্যাম ভেরি মাচ ব্রেকেবল। আমি হয়তো নিজেকে সেরকম দেখাতে পারি। কিন্তু আমি দুঃখ পেলে অণু-পরমাণুতে বিভক্ত হয়ে যাই, এতটাই কষ্ট পাই। বিশেষ করে যাদের উপর আস্থা রাখি, তাদের কাছ থেকে দুঃখ পেলে। কিন্তু আমি সেটা কখনও দেখাই না। তাই আমি খুব তাড়াতাড়ি সামলে উঠতে পারি।

Aparajita Adhya with husband Atanu Ghosh বিয়ের দিনে স্বামী অতনু ঘোষের সঙ্গে। ছবি সৌজন্য: অপরাজিতা

আরও পড়ুন: মানুষ চাইলেও কিন্তু ‘পারি’-কে ভুলতে পারবে না: অপরাজিতা

অতনুদা, আপনার স্বামীর সঙ্গে প্রেমটা কীভাবে হল?

ওর সঙ্গে ঠিক প্রেম হয়নি। ৯৬-এ যখন বাবা মারা যায় তখন খালি মনে হতো আর আমি ওই বাড়িটাতে থাকতে পারব না। কারণ বাবার সঙ্গেই আমার সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব ছিল। একটা শুটিংয়ে গিয়ে অতনুর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তার খুব অল্পদিনের মধ্যেই আমি ওদের বাড়িতে যাই আমার এক বান্ধবীকে নিয়ে। ওর মা-কে দেখে আমার খুব ভাল লেগে যায়। তখন অতনু বলে যে আমার বিয়ের দেখাশোনা চলছে, তুমি যদি রাজি থাকো। আমি তখন বলি, হ্য়াঁ আমি বিয়ে করব তোমাদের বাড়িতে, তোমার মায়ের কাছে থাকব। তখন জাস্ট ১৮ বছর হয়েছে, ৯৭ সাল। ২৬ জুলাই আমাদের রেজিস্ট্রি হয় আর ৮ অগাস্ট আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। অতনু আমাকে ভীষণ সাপোর্ট দিয়েছে। আমরা অসম্ভব ভাল বন্ধু। আজকে আমার সবচেয়ে বড় শান্তি, আমার কোনও কিছু আমার শ্বশুরবাড়িতে লুকনোর দরকার পড়ে না-- না অতনুর কাছে, না আমার শাশুড়ি-মায়ের কাছে। আর যেটা লুকনোর দরকার, সেটা আমার শাশুড়ি নিজে করে নেয়, আমাকে কিছু করতে হয় না। আমি যখন ওই বাড়িতে প্রথম গেলাম, তখন তো পাড়া-প্রতিবেশীদের বুঝতেই সময় লেগে গিয়েছে যে আমি ওবাড়ির বউ। সেই সময় অতনুরাও এই পাড়ায় নতুন বাড়ি করে এসেছে। সবাই ভাবত আমি ওই বাড়ির মেয়ে। আমার শাশুড়িকে অনেকে এসে বলতো, ওমা কী সুন্দর দেখতে, আমার বাড়ির ছেলে আছে, বিয়ে দেবে? আবার কোনও ছেলে আমার শাশুড়িকে ফোন করে বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, আমার শাশুড়ি তাকে বলেছে, বাবা তোমাকে দুঃখ দিতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কী করব বলো, ও তো আমার মেয়ে নয়, আমার ছেলের বউ। এরকম এত ঘটনা রয়েছে যে একটা সিনেমা হয়ে যাবে। আর আমার শ্বশুরবাড়ির সকলের মধ্যে বোঝাপড়াটা অসম্ভব ভালো। সত্য যতই রূঢ় হোক না কেন, সেটা স্বীকার করার ক্ষমতা রাখি আমরা।

Aparajita Adhya exclusive on personal life ছবি: শশী ঘোষ (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)

আপনার শাশুড়ি মায়ের কথা আর একটু বলুন...

আমার শাশুড়ি মা আমার খুব বন্ধু। আমার মায়ের সঙ্গে আমার একটু গ্যাপ রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই খুবই অনুশাসনের মধ্যে বড় হয়েছি। আমি এখনও আমার মা-কে অসম্ভব ভয় পাই। মায়ের মুখের উপর কথা বলতে পারি না, দিদার মুখের উপর তো কখনও কথাই বলিনি। দিদা ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ, ঢাকার প্রথম মহিলা যিনি ম্যাট্রিকে প্রথম হয়েছিলেন-- বিভা ঘোষ। সূর্য সেনের ছাত্রী ছিলেন। ওনার আদর্শটাই আলাদা। এখন অনেকে আদর্শের কথা বললে আমার হাসি পায় কারণ আদর্শ কী হয় সেটা ওনার কাছ থেকেই আমার শেখা। আমার দিদা ছিলেন এমন একজন মহিলা, দাদু যখন আর একটা বিয়ে করে আনলেন, সেই অবস্থায় মেয়েদের নিয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। হাওড়ার তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ওই স্কুলেই উনি পরে হেডমিস্ট্রেসের দায়িত্ব সামলেছেন অনেক বছর। আমার মা হচ্ছে তখনকার দিনে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির পলিটিকাল সায়েন্সের এমএ, আমার মাসি ইংলিশে ডাবল এমএ। এতটা পড়াশোনা করিয়েই দিদা মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন। তাই সেই মায়ের মেয়ের কতটা অনুশাসন থাকবে তুমি বুঝতেই পারছ। স্বাধীনতা কাকে বলে সেটা আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে এসে বুঝেছি। আমার শাশুড়ি মায়ের কাছে আসার পরে মনে হল আমি বিশাল একটা খোলা আকাশের মধ্যে চলে এসেছি অথচ যেটা খুব সিকিওরড। ওনার মাতৃত্বটা এতটাই স্ট্রং। আমি শ্বশুরবাড়িতে এসে বুঝলাম, আমার জীবনে যেমন অনেক না আছে, আমার শাশুড়ির জীবনেও অনেক না রয়েছে। আমরা দুজন দুজনের না-গুলো ভেঙে দিলাম, দিয়ে দুজনেই খুব মুক্ত হয়ে গেলাম। আমরা একে অপরের বাঁচার আধার হয়ে উঠলাম। এতটাই স্ট্রং ছিল সেটা, একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। আজ থেকে পনেরো বছর আগে আমি প্রথম বম্বে থেকে অফার পাই, সেখানকার টেলিভিশনে কাজ করার জন্য। তখন উনি রিটায়ার করেননি, অনেকদিন চাকরি রয়েছে। আমার শাশুড়ি বলেছিলেন যে আমি ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নিচ্ছি, তোমাকে নিয়ে বম্বে চলে যাব। তখন বরং আমি বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইনি কারণ তো আমার তো ননদ, শ্বশুর, খুড়শ্বশুর সবাইকেই চাই, দিদিশাশুড়ি তখন বেঁচে ছিলেন, তাঁকেও চাই। এটা একদম সত্যি যে আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার বেশিরভাগটাই আমার শাশুড়ি মায়ের জন্য। যখন বিপদে পড়েছি, কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, উনি পারতেন আমাকে ভুল বুঝতে। কিন্তু সেটা উনি খুব স্নেহ দিয়ে ট্যাকল করেছেন। আমি বলব উনি বুদ্ধিমতী তো বটেই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি উনি বিদূষী। কোনও পরিস্থিতি হয়তো চরমে যেতে পারে, তার থেকে উনি ঠিক আমাকে প্রোটেক্ট করে নেন। ওনার এই ব্যাপারটার জন্যেই আজকে আমার মেরুদণ্ডটা অনেক শক্ত হয়েছে।

Aparajita Adhya with husband and in-laws স্বামী ও শাশুড়ির সঙ্গে বিয়ের দিনে। ছবি সৌজন্য: অপরাজিতা

আপনার তো একটা আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে...

আধ্যাত্মিক দিকটা আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল। আমি ঈশ্বরের সঙ্গে খুব কানেক্টেড। আমার মা-ও খুব পুজোআচ্চা করেন। আমি কিন্তু নিয়মে কিছু করতে পারি না। বার, ব্রত, উপোষ এসব কিছুই করি না। আমি ছোটবেলা থেকেই কিছু খেলা ভগবানের সঙ্গে খেলতাম। হয়তো একটা পুতুল নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কোলে দিচ্ছি আবার নিজের কোলে নিচ্ছি। আমার চিরকালই মনে হতো, ঈশ্বর তো মানুষের বন্ধু, তবে এত ডু'জ অ্যান্ড ডোন্ট'জ কেন? দিদা একটা কথা বলতেন, মানুষের জন্য নিয়ম, নিয়মের জন্য মানুষ নয়। খিদে পাচ্ছে তবু না খেয়ে পুজো করা, আমি কোনওদিনই এগুলো করি না। কিন্তু আমার ঈশ্বরের সঙ্গে অদ্ভুত একটা বন্ডিং। পরে যখন আমার গুরুদেবকে পেলাম, তিনিও এই সবে বিশ্বাসীই নন-- না যন্ত্র, না মন্ত্র, না ফুল, আমরা ফুলের বলিতে বিশ্বাসই করি না। আমাদের হচ্ছে শুধু ধ্যান আর আত্মশুদ্ধি। নিজেকে যদি সৎপথে রাখা যায়, নিজেকে যদি শুদ্ধ রাখা যায়, তাহলে পরিস্থিতিটা এমনিই চেঞ্জ হয়ে যায়। ভগবান আর কোথাও নেই, তোমার মধ্যেই রয়েছেন। মানুষ... মান ও হুঁশ যদি ঠিক রাখা যায় তবে সেটা সবচেয়ে বড় আধ্যাত্মিকতা। সেটাই আমরা অভ্যাস করি।

আপনার হাসিটা অসম্ভব সুন্দর। সবাই আপনার হাসিতে মুগ্ধ। এই হাসির রহস্য কী?

আমি জীবন প্রচুর দেখেছি। জীবন আমি সব ভাবে দেখেছি। জীবনের অন্ধকার দিকগুলো কী কী হয়, সেগুলো আমার জানা, সবটা দেখা না হলেও। সবক্ষেত্রে তো দেখা সম্ভব নয়। আমি বহু কাছের মানুষকে পাল্টে যেতে দেখেছি। বহু পাল্টে যাওয়া মানুষকে সিধে হতে দেখেছি। সুতরাং কোনও কিছুই চিরকালীন নয়। সবের মূলে হচ্ছে বর্তমান। না অতীতে কিছু আছে, আর ভবিষ্যৎ তুমি জানো না। সুতরাং বর্তমানটাই হচ্ছে শাশ্বত। আমি বর্তমান নিয়ে বাঁচতে জানি। আমি প্রত্যেকদিন যখন ঘুম থেকে উঠি, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই যে আমি আর একটা নতুন দিন দেখলাম। ইচ ডে ইজ আ নিউ ডে, নিউ বর্ন। সুতরাং সেই জন্যেই আমি হাসি।

bengali films Bengali Television Bengali Actress
Advertisment