বাঙালির আত্মসম্মান যে আজও ভয়ঙ্কর, সেটা যে ঠুনকো নয়, তাঁর শিরদাঁড়া যে আজও সোজা, সেকথা যেন প্রমাণ করলেন সুদীপ্তা চক্রবর্তী। গতকাল তিনি এক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে বাংলা সরকারের তরফে পাওয়া সম্মাননা এবং পুরস্কার বিশেষ চলচ্চিত্র সম্মান তিনি ফেরত দেবেন। কারণ, দিন দুয়েক আগেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এক সদস্য এবং বিধায়ক কাঞ্চন মল্লিক প্রশ্ন করে বসেন, টলিউডের যারা পা মিলিয়েছেন এই প্রতিবাদে, তারা ফেরত দেবেন তো সরকারের তরফে পাওয়া পুরস্কার?
ফিল্মি বন্ধুর তরফে এহেন কটাক্ষ যেন গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছিল তাঁর। তাই তো আর দেরি না করেই সুদীপ্তা এমন এক কাজ করলেন যাতে গোটা বাংলার মানুষ তাঁর প্রশংসার পাশাপাশি তাঁর সাহসিকতা দেখে বাহবা জানিয়েছেন। বাঙালির আত্মসম্মান যে ঠুনকো নয়, সেটাই যেন প্রমাণ হল। সুদীপ্তা চক্রবর্তীর এই সিদ্ধান্তের আগে তিনি ঠিক কী ভাবছিলেন, সেটা জানতেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার তরফে ফোন গিয়েছিল।
পুরস্কার ফেরালেন সুদীপ্তা...
অভিনেত্রী এত যে প্রশংসা পাচ্ছেন, ফের একবার 'শিরদাঁড়া বিক্রয় নাই...' শব্দটার যথাযথ ব্যাখ্যা দিলেন তিনি, এই প্রসঙ্গে প্রথম কথা তিনি এটাই বললেন, "আজকে আমার বাবাকে খুব মিস করছি। কিছুক্ষণ আগেই আমার এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ও আমাদের ইন্ডাস্ট্রির মানুষ। আগে কাজ করতেন। এখন এত সব দাদাগিরি, দালালির চাপে পড়ে আর কাজ করতে পারেন না। ও বলছিল, যে জানিস এতদিন ধরে কার্বন ডাই অক্সাইড নিতে নিতে, সব মেনে নিতে নিতে যেন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, নিজের অস্তিত্ব-সত্বা বজায় রাখার। হঠাৎ শেষ ২০ দিন ধরে মনে হচ্ছে শরীরটায় অক্সিজেন ঢুকছে।"
এই যে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত, সরকারের তরফে পাওয়া পুরস্কার তথা সম্মান ফেরানো, অভিনেত্রীর কথায়, রাতারাতি নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। বললেন, "আমার বরকে জানাই এই বিষয়টা যে আমি ফেরত দিতে চাই। ও বলল, হ্যাঁ দাও, ফেরত দাও। তারপরেই দেওয়াল থেকে সার্টিফিকেটটা খুলে নামিয়ে রাখল। তারপর ভাবনা এলো, ইমেলটা কাকে পাঠাবো। শুটিংয়ে চলে গেলাম। তারপর লালবাজার গেলাম, রাত জাগলাম। পরের দিন সকালবেলা অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠে ভাবলাম যে না ইমেলটা পাঠাতে হবে। এদিক ওদিক একটু সবার সাথে যোগাযোগ করে ইমেল আইডিটা খুঁজে বার করলাম।
আপোষ করিনি। আপোষ করবো না। ভেবেছিলাম সরকারি পুরস্কার আমার যোগ্যতার জন্য দেওয়া হয়েছিল। পরশু রাতে মাননীয় বিধায়ক যখন দাবি...
Posted by Sudipta Chakraborty on Tuesday, September 3, 2024
মেলটা লেখার পরেই অভিনেত্রী একে একে তার পরিবারকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। প্রথম ফোনটি করেন মাকে। অভিনেত্রী বললেন, "মা ট্রাভেল করছিলেন, প্রথম ফোনটা মাকে করে বললাম যে এরকম একটা কাজ করেছি। মা বললেন, আচ্ছা খুব ভালো করেছো। তারপর দিদিকে ফোন করে বলেছি। এরকম কিন্তু নয় যে কারওর সঙ্গে আলোচনা করেছি, আমি শুধু ওদেরকে আমার সিদ্ধান্তটা জানিয়েছি। তাও ইমেল করার পরে।" একের পর এক আন্দোলনে তারা শামিল হচ্ছেন। কলকাতার পাশাপাশি রাজ্যজুড়েও মিছিল এবং আন্দোলনের রেশ। খেয়াল করলেই দেখা যাবে একটি বাক্য খুব শোনা যাচ্ছে... 'আগে মিছিল মানুষ খুঁজতো, এখন মানুষ মিছিল খুঁজছে'।
এই বাক্যটির সাপেক্ষেই, অভিনেত্রী বলেন, "এটি একদম সত্যি কথা। মানুষ এখন সত্যি আন্দোলনে যোগ দিতে চাইছে। মানুষ নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না যে কোন আন্দোলনে যাবেন, কোন মিছিলে গিয়ে একটু প্রতিবাদ করবেন।" কিছুদিন ধরেই টলিপাড়ায়, দক্ষিণ ইন্ডাস্ট্রির মতই যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। অভিনেত্রী ঋতাভরী, তিনি প্রথম মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি অভিযোগ লেখেন। সুদীপ্তা নিজে এই ইন্ডাস্ট্রিতে, এত বছর ধরে কাজ করেছেন। পাশাপাশি অভিনেতা বিপ্লব কেতন চক্রবর্তীর মেয়ে হওয়ার সুবাদে, অনেক মানুষকে বেশ কাছ থেকে চেনেন। কিন্তু তিনি কি ব্যক্তিগতভাবে কোনওদিন, এই ধরনের হেনস্থার শিকার হয়েছেন? উত্তরে অভিনেত্রী বলেন...
"ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনদিন এরকম ধরনের প্রস্তাব পাইনি। কিন্তু মহিলাদের সামনে গালাগালি দেওয়া, কটু কথা বলা এগুলো তো হয়েই থাকে। কেউ তোয়াক্কাই করে না যে সামনে মহিলা আছে না বাচ্চা। সেই বিষয়গুলোকে এতদিন এড়িয়ে এসেছি। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে ইন্ডাস্ট্রিতে এরকম ঘটনা ঘটে না। এটা ছিল এটা আছে।"
একটি মেয়ে, যার বাড়ির পর তার দ্বিতীয় বাড়ি কর্মক্ষেত্র, সেখানেই সে সুরক্ষিত নয়। একটি মেয়েকে সুরক্ষা দিতে রাত্রে শিফট কমছে। যতটা সম্ভব মেয়েদের শিফট রাত্রে কমিয়ে দেওয়া হবে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। গতকাল রাত্রিরের সাথী প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় বলেনও। তারপরেই শুরু হয় আবারও আলোচনা এবং সমালোচনা। কিন্তু এই যে মেয়েদেরকে সুরক্ষা দিতে রাত্রিবেলা বন্ধ করে রাখা, তাতে যেন ভাষা হারিয়েছেন সুদীপ্তা।
অভিনেত্রী বলেন, "উনি তো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নতে যদি রাত অব্দি একটা মিটিং চলে, তাহলে কি উনি থাকবেন না? উনি রাত আটটার আগে বাড়ি চলে যাবেন? একটা যদি এমার্জেন্সি পরিস্থিতি হয়, বা এই যে যে ভোটের আগে এত ব্যস্ততা, কত ধরনের আলোচনা প্ল্যানিং কত কি থাকে, তখন উনি রাত্রিবেলা থাকবেন না? তাহলে সেটা যদি না হয়, তবে উনি কী করে আশা করছেন যে অন্যান্য মহিলারা রাত্রি আটটার মধ্যে বাড়ি চলে যাবেন বা রাত্রিবেলা কাজ করবেন না?"