ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে শীতের প্রকোপে হাড় কাঁপে নি, ঠাণ্ডা ছিল সহনীয়, ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বিশ্রী আবহাওয়া, বৃষ্টি, কনকনে বাতাস, তুষারপাতের উৎপাত, ঘর ছেড়ে বেরোনো দায়।
সিনেমাপ্রেমীরা অবশ্য এসবের তোয়াক্কা করে না। হেতু নেই করার, বিশ্বের নানা দেশের উল্লেখযোগ্য ছবি তো হামেশা দেখা যায় না প্রেক্ষাগৃহে। চাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এবং এই উৎসব যদি হয় 'বার্লিনাল' (বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পোশাকি নাম), তবে তো কথাই নেই। এবার উৎসবের ৭০ বছর পূর্তি।সেই উপলক্ষ্যে বিশেষ আয়োজন নেই, তবে চারটি নতুন বিভাগ সংযুক্ত, বিশেষত 'এনকাউন্টার'। মূল প্রতিযোগিতামূলক ছবির বিকল্প।
আরও পড়ুন, স্টার জলসা-তেও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের বায়োপিক! এবার লড়াই দুই চ্যানেলে
আবার ভারতের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে যে রাজনীতি, রাজনৈতিক লীলাখেলা, আমরা তাও দেখলুম। উৎসব চত্বরে শতাধিক নারী ও পুরুষ, ভারতের এবং জার্মানির, সমবেত চিৎকার করছেন, স্লোগান দিচ্ছেন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। পুলিশ কিছু বলছে না। মুম্বইয়ের বাসন্তী কার্লেকর বললেন, "ভারত সেকুলার, সব ধর্মীয় মানুষই ভারতের, কোনও বিভাজন চলবে না। আমরা প্রতিবাদ করছি, জানাচ্ছি আমাদের ক্ষোভ, জানুক উৎসবে আগত বিশ্বের চলচ্চিত্র বোদ্ধারা।" শীত উপেক্ষা করে।
পৃথিবী জুড়ে ১০ হাজারের বেশি চলচ্চিত্র উৎসব, দেশে দেশে। কিন্তু নজর কাড়ে কান, বার্লিন, ভেনিস। কান-এর মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। অতঃপর বার্লিন ও ভেনিস। এই তিনটি উৎসবে কোনও ছবি পুরস্কৃত হলে ছবি গৌরবান্বিত। পরিচালকও আলোচিত। 'অস্কার' (হলিউডের) পুরস্কার মূলত 'পপুলার' তথা বাণিজ্যিক ছবির জন্যই। ইদানীং অবশ্য চরিত্র পাল্টাচ্ছে, বিদেশি ছবিকেও পুরস্কৃত করা হচ্ছে। না করে উপায় নেই। হলিউডের ছবি মানেই প্রেম আর ক্রাইম। শিল্পের বদলে অশিল্প। বাণিজ্যমাখা। আসলে, সাধারণ তথা আমজনতা (দর্শক) যা চায়। যেমন ভারতের বলিউডের ছবি। কোন প্রযোজক আর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে 'আর্ট ফিল্ম' করতে চান। সিনেমা মানেই বাণিজ্য। বাণিজ্যে বসতেঃ লক্ষ্মী।
ঠিক যে, আমেরিকার সব ছবিই 'হলিউডি' নয়। বহু প্রযোজক, যাঁরা হলিউড-যুক্ত নন, শিল্পসম্মত ছবি নির্মাণে উৎসাহী। যেমন '৭০ বার্লিনালে' দেখা গেল 'মাই স্যালিঞ্জার ইয়ার (My Salinger Year)'। ছবির কাহিনি আহামরি কিছু নয়, একজন লেখকের এজেন্ট কীভাবে নিজেই লেখার জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং নিজেও লেখক হয়ে ওঠেন শেষাবধি। কাহিনির নানা পর্বে 'নিউ ইয়র্কার' পত্রিকার প্রচারণা বিরক্তিকর হলেও নির্মাণ কারুকলায় মুনশিয়ানা স্বীকার্য।
'মাই স্যালিঞ্জার ইয়ার' উদ্বোধনী ছবি, প্রতিযোগিতার বাইরে। বার্লিনালের গৌরব, আমেরিকার ছবিকে তারা প্রাধান্য দেয় না, কিন্তু এবার দিয়েছে, 'ভালো ছবির' তালিকায়, উৎসব কর্তৃপক্ষের বয়ান। অন্য কোনও দেশের চলচ্চিত্র উৎসব নয়, তবে বার্লিনালের মূল লক্ষ্য, রাজনৈতিক ছবিই মূল আকর্ষণ। এবারও তা বাদ দেয় নি। বিশ্বের নানা দেশে রাজনৈতিক ছবি নির্মিত, কিন্তু দেশীয় সরকারের রোষে মুক্তি পায় না, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব সেদিক থেকে উদার।
উদ্বোধনী সন্ধ্যায় (২০ ফেব্রুয়ারি) পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে জার্মানির সংস্কৃতি মন্ত্রী মনিকা গ্রুয়েটারস বক্তৃতার মাঝখানে হঠাৎই চুপ, কয়েক সেকেন্ড। বললেন, "উৎসব উদ্বোধন করছি, কিন্তু আমি দুঃখকষ্টে ভারাক্রান্ত, লজ্জায় মুখ দেখানো অনুচিত। আজ হানাউ-এ (ফ্রাঙ্কফুর্ট সংলগ্ন শহরে) জার্মানির চরম দক্ষিণপন্থীরা আটজন বিদেশিকে হত্যা করেছে। সরকার কলঙ্কিত, আমরা কলঙ্কিত, জার্মানির শান্তিপ্রিয় মানুষও। ক্ষমা করবেন আমাদের। খুনিদের রেহাই নেই। আমরা উদ্বাস্তু, বিদেশি, বা ধর্মাধর্ম নিয়ে বিদ্বেষী নই, বরং বৈশ্বিক মানবিকতায় বিশ্বাসী। ইউরোপের মধ্যে জার্মানিতেই সবচেয়ে বেশি বিদেশি। আসুন, নিহতদের উদ্দেশ্যে নীরবতা পালন করি।" গোটা প্রেক্ষাগৃহ দাঁড়িয়ে। দুই মিনিট নীরবতা।
বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবকে নিছকই বিনোদনমূলক বলা যাবে না, রাজনীতির চলচ্চিত্র উৎসবও।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন