বিগত কয়েক বছরে থিম পুজোর বাড়বাড়ন্ত হওয়ায় শারদোৎসবে সাবেকিয়ানা কমে গিয়েছে, এমনটাই বক্তব্য সদ্যগঠিত 'বঙ্গ প্রয়াস'-এর সদস্যদের। তাই এবছর শারদোৎসবে সেরা সাবেকি পুজোকে সম্মানিত করতে উদ্যোগী এই সংস্থা। কিন্তু শারদ সম্মানের এই আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে 'পদ্ম' এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নাম যা এই উদ্যোগের সঙ্গে গেরুয়া রাজনীতির প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে নির্দেশ করে। তবে সংগঠনের সদস্যরা এই উদ্যোগকে রাজনৈতিক বলতে নারাজ।
১৭ সেপ্টেম্বর কলকাতার প্রেস ক্লাবে একটি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে 'বঙ্গ প্রয়াস'-এর শারদ সম্মানের ঘোষণা করলেন সংস্থার অগ্রগণী সদস্যরা, যাঁদের অধিকাংশই ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। এদিন সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অঞ্জনা বসু, মৌমিতা গুপ্ত, অনিন্দ্যপুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপা ভট্টাচার্য, কাঞ্চনা মৈত্র, সৌরভ চক্রবর্তী, রূপাঞ্জনা মিত্র, লামা হালদার-সহ টলিপাড়ার একাধিক শিল্পীরা। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পাল ও বর্ষীয়ান প্রতিমা শিল্পী নিরঞ্জন প্রধান।
আরও পড়ুন: Durga Puja 2019: জেনে নিন এ বছরের দুর্গা পুজোর নির্ঘণ্ট
'বঙ্গ প্রয়াস'-এর পক্ষ থেকে অঞ্জনা বসু জানালেন, এই সংগঠন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মানুষের পাশে থাকতে চায়। কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণ দেওয়া থেকে শুরু করে গুণীজনের সম্মান, নানা ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু 'বঙ্গ প্রয়াস' তাদের পথচলা শুরু করতে চায় শারদোৎসব দিয়ে। তাই 'বঙ্গ প্রয়াস'-এর প্রথম পদক্ষেপ-- শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি শারদ সম্মান।
দশটি সাবেকি বারোয়ারি পুজো ও কলকাতাকেন্দ্রিক সেরা কয়েকটি আবাসনের পুজোকে সম্মানিত করা হবে, এমনটাই জানিয়েছেন সংগঠনের সদস্যরা। এর মধ্যে দশটি বারোয়ারি পুজো ইতিমধ্যেই নির্বাচিত, যারা বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে থিম নয়, সাবেকি মতেই পুজো করে আসছেন। কিন্তু আবাসনের পুজোগুলির মধ্যে চলবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী ও ষষ্ঠী-- এই চারদিন ধরেই 'বঙ্গ প্রয়াস'-এর পক্ষ থেকে শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের একটি বিচারকমণ্ডলী বিভিন্ন আবাসনের পুজোগুলির পরিক্রমা করে বেছে নেবেন-- শ্রেষ্ঠ প্রতিমা, শ্রেষ্ঠ প্রতিমা শিল্পী, শ্রেষ্ঠ পরিবেশ ও আজকের দশভুজা-- বিভাগের বিজয়ীদের। পুরস্কার ঘোষণা হবে সপ্তমীতে।
এই শারদ সম্মানে কোনও অর্থ পুরস্কার নেই। বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে স্মারক। এছাড়া রূপা ভট্টাচার্য জানালেন পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানোর জন্য পুজো কমিটিগুলির হাতে গাছও তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই শারদ সম্মানের নামকরণ কেন করা হল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে, যিনি জনসঙ্ঘ-র প্রতিষ্ঠাতা এবং এদেশের গেরুয়া রাজনৈতিক শিবিরে অত্যন্ত সমাদৃত।
আরও পড়ুন: বছরে ১৫ কোটি টাকা লগ্নি, প্রতিকূলতা নিয়েও মাথা উঁচু করে বাঁচে কলকাতার যাত্রাশিল্প
'বঙ্গ প্রয়াস'-এর সদস্যদের বক্তব্য, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলার একজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যিনি বাংলার সংস্কৃতি ও সাবেকিয়ানার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাই তাঁর নামেই এই সম্মান। তবে এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায় 'বঙ্গ প্রয়াস'-এর শারদ সম্মান-এর ক্যাচলাইন নিয়ে-- 'পদ্ম ছাড়া দুর্গা পুজো হয় নাকি?' এই বাক্যটি অনেকটা দুদিকেই ধারসম্পন্ন তলোয়ারের মতো।
পুজোর নিয়ম অনুযায়ী, পদ্ম ছাড়া সত্যিই দুর্গাপুজো অসম্ভব কারণ পুরাণ মতে, দেবী দুর্গাকে ১০৮টি পদ্ম দিয়েই পুজো করতে হয় অষ্টমী তিথিতে। যেহেতু গেরুয়া রাজনীতির প্রতীক পদ্মফুল, তাই সদ্য বিজেপি-র সদস্যপদ নেওয়া টলিপাড়ার একঝাঁক শিল্পী যখন শারদ সম্মানের ঘোষণা করেন যার ক্যাচলাইন-- 'পদ্ম ছাড়া দুর্গা পুজো হয় নাকি'-- তখন উদ্যোগের রাজনৈতিক মেরুকরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। অভিজ্ঞমহলের মতে, এবছর বিজেপি-র পক্ষ থেকে কলকাতার বড় পুজো কমিটিগুলিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করা হয়। সেই কাজে অসফল হওয়ায় ঘুরপথে শারদ সম্মান-এর মাধ্যমে শারদোৎসবে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের একটি প্রচেষ্টা এই বিশেষ শারদ সম্মান।
কিন্তু উদ্যোক্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, 'বঙ্গ প্রয়াস' একটি অরাজনৈতিক উদ্যোগ। এখানকার সদস্যরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও পেশা থেকে এসেছেন এবং তাঁরা সবাই যে গেরুয়া রাজনীতির অংশ, তেমনটা নয়। তাই 'পদ্ম ছাড়া দুর্গা পুজো হয় নাকি'-- এই স্লোগানের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক রং নেই বলেই দাবি করেছেন সংস্থার সদস্যরা।
আরও পড়ুন: ‘মন বৈরাগী’ নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে ছবির প্রযোজনায় সঞ্জয় লীলা বনশালী
তবে কিছুদিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন যে সারা পশ্চিমবঙ্গের রেজিস্টার্ড পুজো কমিটিগুলিকে শারদোৎসব উপলক্ষে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। আর যদি সেই ক্লাবটি মহিলা-পরিচালিত হয়, তবে সেই ক্লাব পাবে ৩০ হাজার টাকা। তার পরেই 'বঙ্গ প্রয়াস'-এর এই শারদ সম্মান-এর ঘোষণার মধ্যে কি কোনও প্রচ্ছন্ন রাজনীতি লুকিয়ে নেই?
সংস্থার সদস্য রূপা ভট্টাচার্য এই প্রসঙ্গে বলেন, ''আমরা ব্যক্তিগতভাবে উৎকোচ দেওয়াতে উৎসাহী নই। আমাদের শারদ সম্মান-এ কোনও টাকা নেই, তাই মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে এই উদ্যোগের কোনও যোগসূত্রই নেই। বঙ্গ প্রয়াস একটি অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। এখানে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই ঘোষিত ভাবে বিজেপি-সমর্থক বা কর্মী। কিন্তু এমন আরও অনেকে রয়েছেন যাঁরা অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কিন্তু তাঁদের গায়ে কোনও ঘোষিত ট্যাগ নেই। আমরা বিজেপি-কর্মী হওয়া ছাড়াও আমাদের প্রত্যেকেরই একটা অন্য পরিচয় রয়েছে-- কেউ শিল্পী, কেউ গায়ক, কেউ সাংবাদিক। কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের এই উদ্যোগ নয়। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে থাকা, সেই লক্ষ্যেই আমাদের এই প্রয়াস।''