করোনা সংক্রমণ নিয়ে মানুষের মনে নানা ধরনের ভীতি এবং আশঙ্কা যেমন কাজ করছে, পাশাপাশি বহু মানুষ কুসংস্কারের বশে পশুদের প্রতি অকারণ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অথবা WHO-এর করোনা সংক্রান্ত প্যামফ্লেটের বক্তব্য অনুযায়ী, এই ভাইরাস কোনওভাবেই পশুদের মাধ্যমে ছড়ায় না এবং পশুরা এই ভাইরাসের বাহক নয়। তার পরেও বহু মানুষ বাড়ির পোষ্যদের ত্যাগ করছেন, অনেকে দল বেঁধে প্রতিবেশীর বাড়িতে ঢুকে জোর করে তাদের পোষ্যদের তুলে নিয়ে এসেছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। মানুষের এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারকারা।
দেবলীনা দত্ত ও তথাগত মুখোপাধ্যায়ের পশুপ্রেমের কথা বাংলার মানুষের কাছে খুব একটা অজানা নয়। তেমনই শ্রীলেখা মিত্র, গীতশ্রী রায়, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌরভ দাস-সহ বাংলার বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী রয়েছেন যাঁরা সারা বছরই পশুদের জন্য কাজ করেন। করোনা লকডাউনে রাস্তার পশুপাখিরা যাতে অনাহারে না থাকে, তার জন্য বাড়ির বাইরে এই কদিন খাবার রাখার কথাও বলেছিলেন জয়ী দেবরায়। লকডাউনের মধ্যেই শ্রীলেখা, তথাগত, দেবলীনা, গীতশ্রী এলাকার কুকুর-বেড়ালদের খাবারের বন্দোবস্ত করেছেন।
আরও পড়ুন: করোনা প্রতিরোধে ঘাটালকে ১ কোটি অর্থ সাহায্য দেবের
এমনিতেই সারা বছরই এই নিয়ে নাগরিকদের একাংশের থেকে সমালোচনা শুনতে হয় তাঁদের কারণ নাগরিকদের অনেকেই মনে করেন রাস্তার কুকুর-বেড়ালেরা শহর নোংরা করে। করোনার সময় সেই সব মানুষের পশুঘৃণা যেন কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে কেউ পুরোপুরি কুসংস্কারাচ্ছন্ন, মনে করছেন যে পশুদের মাধ্যমে এই অসুখ ছড়িয়ে পড়ছে। আর একদল এই সংক্রামক ভাইরাসের অছিলায় পশুদের উপর নৃশংস হয়ে উঠছেন, এমনটাই মনে করছেন দেবলীনা-তথাগত-শ্রীলেখারা।
২৭ মার্চ ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্ট লেখেন তথাগত মুখোপাধ্যায়। কলকাতার একটি পাড়ায় দুটি বাড়ি থেকে প্রায় ৩৬টি পোষ্য বেড়ালকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রীতিমতো গায়ের জোরে বাড়িতে ঢুকে এক বৃদ্ধ দম্পতির পোষা প্রায় ৩০টি বেড়াল ও তার উল্টোদিকের আর একটি বাড়ি থেকে ৬টি পোষ্য বেড়াল তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার ভিডিওটি শেয়ার করেছেন তথাগত যা দেখে নিতে পারেন নীচের লিঙ্কে। শোনা গিয়েছে যে থানা থেকে আসছি বলে কিছু মানুষ এই কাজটি করেছেন। তাঁরা সবাই সিভিল ড্রেসে ছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে কোনও ওয়ারেন্ট ছিল না। এই বেড়ালগুলি ভাইরাস ছড়াচ্ছে বলে একটি অভিযোগ তার কয়েকদিন আগেই জমা পড়ে নিকটবর্তী থানায়।
করোনা নিয়ে সম্পূর্ণ কুসংস্কারের বশে এই কাজের তীব্র নিন্দা করেছেন তথাগত মুখোপাধ্যায়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে তিনি বলেন, ''যা ঘটেছে সেটা গুন্ডামি। আর বেড়াল-কুকুরের থেকে যে এই রোগ ছড়ায় না তা বার বার করে WHO-র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। মানুষ তার পরেও এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করছেন কী করে? শুধু রাস্তার কুকুর-বেড়াল তো নয়, বিগত ৮ দিনে প্রায় ১৪-১৫টি বাড়ির পোষ্যকে অ্যাবানডন করা হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না এই মানুষেরা কারা, তারা তো শিক্ষিত মানুষ, সভ্য জায়গায় ঘোরাফেরা করে। কী করে এগুলো করতে পারছে তারা।''
উপরের পোষ্য বেড়াল তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে চারটি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন দেবলীনা--
প্রথমত, মানুষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনকে কোনও গুরুত্বই দিচ্ছেন না। সেখানে বলা আছে যে পশুদের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায় না, তার পরেও মানুষ রাস্তার পশুপাখি ও বাড়ির পোষ্যদের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠছেন।
দ্বিতীয়ত, বাড়িতে ঢুকে বেড়াল তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, দল বেঁধে একদল মানুষ চড়াও হলেন এক নাগরিকের বাড়িতে এবং সেখানে একজন ছাড়া কারও মুখেই মাস্ক নেই। অর্থাৎ সরকার যে নির্দেশাবলী মেনে চলতে বলছেন এই সময়ে, সেগুলো লঙ্ঘন করা হল।
আরও পড়ুন: করোনা থিমে নিজের সংলাপের মিম বানালেন মিমি, লকডাউনে আসবে আরও
তৃতীয়ত, বাড়ির পোষ্য হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অন্তর্গত, ভারতীয় আইন অনুযায়ী। তাই বাড়ির পোষ্যকে তুলে নিয়ে যাওয়া ও বাড়ির কোনও আসবাব তুলে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই, যা কি না আসলে একটি নন-বেলেবল অফেন্স। অথচ বাড়ির পোষ্য বা পশুপাখিদের উপর কোনও অপরাধ সংঘটিত হলে বেশিরভাগ সময়েই পুলিশ অভিযোগ দায়ের করতে চান না।
চতুর্থত, উপরের ভিডিও ক্লিপে দেখা গিয়েছে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর অভিযোগে মানুষ মাস্ক না পরেই বেড়াল তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। যদি পশুদের থেকে সংক্রমণের ভয়েই এই কাজ, তবে তো মাস্ক ও গ্লাভস পরে আসার কথা। অর্থাৎ এমনটা সম্ভব যে আদৌ কোনও ভয় বা আতঙ্ক কাজ করছে না। এই সুযোগে কিছু মানুষ যাঁরা নাগরিক এলাকায় পশুপাখি অপছন্দ করেন, তাঁরা করোনার অজুহাত দেখিয়ে পাড়া থেকে পশুপাখিদের তুলে নিয়ে যাচ্ছেন বা বার করে দিচ্ছেন।
''সবাই তো অ্যানিমাল লাভার নন কিন্তু এই লকডাউনের সময়ে আমাদের কথা শুনে বা অন্য অ্যানিমাল লাভারদের কথা শুনে বহু মানুষ কিন্তু পশুদের কথা ভাবছেন, তাঁদের খাবার দিচ্ছেন। আবার কিছু মানুষ যাঁরা পশুদের ঘৃণা করেন, তাঁরা করোনা সংক্রমণের ছুতো করে পাড়া থেকে কুকুর-বেড়ালদের তাড়িয়ে দিচ্ছেন। শুধু তো বেড়াল নয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে কুকুরও তোলা হচ্ছে... মানুষ কী পরিমাণ অশিক্ষিত তাই ভাবছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথাও তাঁদের মাথায় ঢুকছে না'', বলেন দেবলীনা।
লকডাউনের সময় শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে যাঁরা রাস্তার পশুপাখিদের খাবার দিতে বেরোচ্ছেন, তাঁদের অনেককেই নানা ধরনের কটূক্তি শুনতে হচ্ছে, হেনস্থাও হতে হচ্ছে। শ্রীলেখা মিত্রকে তাঁর নিজের কমপ্লেক্সেই প্রতিবেশীদের থেকে নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্য ও আচরণ সহ্য করতে হচ্ছে বলে জানালেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে।
''আমার কমপ্লেক্সে কিছু কুকুর থাকে। তাদেরকে সব বার করে দিয়েছে। এখন বাইরে সারাদিন থাকে। রাতের বেলা ভিতরে আসে। কুকুর থেকে নাকি করোনাভাইরাস ছড়ায়। আমি এগুলো শুনে একটা কথাই ভাবছি, মানুষ বহুতলেই থাকুক আর বস্তিতেই থাকুক, মানুষের নেচারটা একই থাকে। খুব খারাপ লাগছে, খুব হতাশার মধ্যে রয়েছি। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই সমস্যা চলছে। কুকুরের বাচ্চাগুলোকে ভিতরে নিয়ে এসেছিলাম নাহলে মরে যেত। তখন থেকেই সমস্যা শুরু করেছে। আমার বাড়ির কুকুরকে নিয়েও সবার সমস্যা। লকডাউনের সময় তো ডগ ওয়াকাররা আসতে পাারছে না। আমিই বাড়ির কমপ্লেক্সে ঘুরছি। পুপ কালেক্টর হাতে নিয়ে সমস্ত জড়ো করে বাড়িতে এসে কমোডে ফেলছি। তার পরেও লোকজন কমপ্লেন করেছে যে কমপ্লেক্স নোংরা হচ্ছে, আমি ইচ্ছে করে এগুলো করছি'', বলেন শ্রীলেখা, ''এদের মানুষ বলতে নিজেরই খারাপ লাগে। আমি তাই এখন মানুষের থেকে পশুদের সঙ্গেই থাকতে বেশি পছন্দ করি।''
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন