জন্মশতবর্ষ আসলে আর একটি অজুহাত, তাঁকে নিয়ে আরও কিছু কথা বলার। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বাঙালি আবেগপ্রবণ পঞ্চাশ বছর আগেও ছিল, পঞ্চাশ বছর পরেও থাকবে। আগামী পৃথিবী, সে যে কোনও টাইম রেফারেন্সেরই 'আগামী' হোক না কেন, কান পেতে তাঁকে শুনবে। সেই শোনার কোনও শেষ নেই। তাঁর গান নিয়ে নির্জন হয়ে ওঠারও কোনও অন্ত নেই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ও তাঁর সৃষ্টি বিরাট একটি সমুদ্র। শ্রোতাদের পা ভেজে, মনও ভিজে যায়। আর বিশেষজ্ঞরা এই মুগ্ধতা পেরিয়ে পৌঁছে যান সমুদ্রের অতলে। সেই অতলের সন্ধান দিলেন বর্তমান কালের দুই প্রখ্যাত সুরকার, দেবজ্যোতি মিশ্র ও ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত।
ভারতীয় সিনেমা, বিশেষত বাংলা ছবির জগত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিল। যে কোনও গানই সৃষ্টি, কিন্তু কিছু সৃষ্টি এমনই হয় যা অপরিহার্য। তাঁর কণ্ঠস্বর যেমন অপরিহার্য ছিল, তেমনই সঙ্গীত পরিচালনাও। 'ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস' বাদে 'শাপমোচন' ছবির ক্লাইম্যাক্স অসম্ভব। আবার একই সুর সম্পূর্ণ দুটি বিপরীত সিনেম্যাটিক সিকোয়েন্সে তিনি ব্যবহার করেছেন, আর দুটি প্রয়োগই দারুণ অভিঘাত তৈরি করে। 'দীপ জ্বেলে যাই' (১৯৫৯) ছবিতে 'এই রাত তোমার আমার' গানটি যে সময়ে আসে, তখন কেন্দ্রীয় চরিত্র মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তার ব্যক্তিগত জীবনের স্বপ্ন তখন ভেঙে চুরমার, এই গানটি ঠিক যেন তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: শতবর্ষে ফিরে দেখা হেমন্তের শ্রেষ্ঠ গানের ডালি
আবার ওই একই সুর ব্যবহৃত হয়েছে 'কোহরা' (১৯৬৪) ছবির মিষ্টি প্রেমের দৃশ্যে। 'ইয়ে নয়ন ডরে ডরে' গানটির দৃশ্যায়ন দেখতে দেখতে ওয়াহিদা-বিশ্বজিতের অন-স্ক্রিন রোমান্সে দর্শক ভেসে যান। সেই মুহূর্তে 'দীপ জ্বেলে যাই'-এর সেই গান ও সুচিত্রা সেনের বুক ভেঙে যাওয়া অভিব্যক্তির কথা মনে পড়ে না। এর জন্য পরিচালকের কৃতিত্ব যতটা, ঠিক ততটাই অপরিহার্য সঙ্গীত পরিচালকের অবদান।
দেবজ্যোতির কথায়, "হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ভারতবর্ষের একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। ভারতীয় চলচ্চিত্র যেই সময়ে হয়ে উঠছে, সেই সময়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা বিরাট অবদান ছিল। এখানে যে ভারতের কথা আমরা বলছি, তা কিন্তু অনেকটা দক্ষিণকে বাদ দিয়ে। দক্ষিণের ছবিকে তখনও আমরা সেভাবে দেখিনি। তাই সেই সময়ের ভারতীয় সিনেমা বলতে আমরা বাংলা এবং হিন্দি সিনেমাকে বুঝি। তখন কিন্তু হিন্দি ছবিতে বাংলা ডমিনেট করত।
"হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ঠিক আগে যেমন হিন্দি ছবিতে শচীন দেব বর্মন এসেছেন, আরও অনেকেই এসেছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কনট্রিবিউশন এটাই যে তিনি এমন কিছু গান তৈরি করেছেন, যে সুর বা মেলোডি তিনি রুক্ষ পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তা একান্ত বাংলার। সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত হোক, বাংলার ভাটিয়ালি হোক, কীর্তন হোক - সেগুলো উনি ব্যবহার করছেন হিন্দি ভাষার ছবিতে এবং বাংলা ছবিতেও। এই যে বিগার একটা ভারত গুজরাট, মহারাষ্ট্র, বা উত্তর ভারতকে কেন্দ্র করে রয়েছে - সেখানকার যাঁরা দর্শক-শ্রোতা, তাঁরা সেই রুক্ষ ভৌগোলিক পরিবেশে বাংলার মেলোডিকে পেলেন, যা কিন্তু হৃদয়ে গ্রাহ্য হলো।
"বাংলার বিভিন্ন ধারার সুরকে মিশিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটা নাগরিক সুরের ধারা তৈরি করলেন যা চলচ্চিত্রের পক্ষে উপযুক্ত। সেই সুরের ধারা দেশের অন্যান্য প্রান্তের নগর-মফস্বলকে ছুঁয়ে গেল। অর্থাৎ বাংলার বাইরে যে ভারত, সেই ভারত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সিনেমার মিউজিকে বাংলাকে পেল। আর বাঙালি কী পেল? বাঙালি অথবা বাংলা তার বহু সুরের ধারাকে একটা গানের মধ্যে পেল। সেই গান বাঙালিরও হৃদয়ে গ্রাহ্য হলো। তাঁর যা সঙ্গীত আয়োজন, তার মধ্যে এত নতুন জিনিস আমরা পেলাম - প্রত্যেকটা গান, যে কোনও গানই বলো - এই রাত তোমার আমার, আষাঢ়-শ্রাবণ মানে না তো মন, নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সমস্ত গানই আমার প্রিয়।'"
কম্পোজার হিসেবে বাংলা ও হিন্দি ছবি মিলিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৭ সালে, এবং শেষ হয় ১৯৮৯-তে তাঁর চিরবিদায়ের সঙ্গে। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ বা আইপিটিএ-র সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯৪৩ সালে। সলিল চৌধুরী ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যুগলবন্দীর সূত্রপাত সেখানেই। ১৯৪৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে 'গাঁয়ের বধূ'। ওই সময় থেকেই বাংলা ছবিতে কম্পোজার হিসেবে হেমন্তের ডাক আসতে থাকে। ওদিকে হিন্দি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম কাজ ছিল 'আনন্দমঠ' (১৯৫২)। পঞ্চাশের দশকে সেই যে এক নক্ষত্রের জন্ম হলো, তার পর থেকেই মৃত্যুকে অতিক্রম করে তিনি সুরের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে রয়ে গেলেন।
যাঁরা কালোত্তীর্ণ স্রষ্টা, তাঁরা নিজের সৃষ্টি নিয়ে কখনও সন্তুষ্ট হন না। সন্তুষ্টি বা তৃপ্তি আসলে একজন শিল্পীর শৈল্পিক জীবনের মৃত্যু ডেকে আনে। 'শাপমোচন' ছবির গানগুলি নাকি তাঁর নিজের একেবারেই পছন্দ ছিল না। একথা বহু সাক্ষাৎকারে বলেছেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ওই ছবির সব গান তাঁকে কম্পোজ করতে হয়। এই তাড়াহুড়োটা তাঁর একদম অপছন্দ ছিল, কিন্তু মুম্বই-কলকাতা অনবরত দৌড়ে বেড়ানো 'হেমন্ত কুমার' বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উপায় ছিল না। অথচ ওই ছবির প্রত্যেকটি গান মানুষের হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে। আর ওই গানগুলি তিনি ছাড়া অন্য কেউ গাইলে ওই অভিঘাত অসম্ভব ছিল।
"ভারতবর্ষে যে ক'জন গায়ক-সঙ্গীত পরিচালক রয়েছেন, হি ইজ দ্য বেস্ট। ওঁর মতো আর কেউ ছিল না। আর কেউ হবে না। 'অদ্বিতীয়া', 'অনুপমা', 'কুহেলি' কোন ছবির নাম করব, প্রত্যেকটা ছবির মিউজিক, তাঁর এক একটি গান আমার কাছে এক একটা মিউজিক ক্লাসের মতো," বলেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। "তাঁর মিউজিকের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি বলতেন, মিউজিককে বেশি প্যাঁচালো কোরো না, বেশি গিটকিরি দিও না। যত সহজভাবে করবে তত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছবে। সিম্পলিসিটি ইন সিংগিং ও সিম্পলিসিটি ইন মিউজিক - এটাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ধরা যাক ওই গানটা, 'ও কোকিলা তোরে শুধাই রে'। কী সিম্পল অথচ স্পিরিচুয়াল।
"আমরা গত ২০ বছর ধরে জঁর নিয়ে কচকচি করছি। আর এই কচকচিতে কোনও লাভ হচ্ছে না। উনি এসব জঁর-টরকে পাত্তাই দিতেন না। যা তাঁর মনের ভিতর থেকে আসত, সেটাই তাঁর মিউজিক। আমার ছোটবেলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম যে গানটি খুব দাগ কেটে গিয়েছিল, সেটি হলো 'সন্ন্যাসী রাজা' ছবির শেষে 'কা তব কান্তা' শ্লোকটি। উনি সুরারোপ করে গেয়েছিলেন। ওটা এখনও শুনলে আমি কাঁদি।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন