বাংলা টেলিভিশনের ইতিহাসে জনপ্রিয় ধারাবাহিক অনেক এসেছে, কিন্তু তার মধ্যে মাইলস্টোন কিন্তু কয়েকটি মাত্র। যদি দূরদর্শন পর্বে মাইলস্টোন হয়ে থাকে 'তেরো পার্বণ' তবে মিলেনিয়াম-পরবর্তী সময়ে প্রাইভেট চ্যানেলের যুগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনা হল 'এক আকাশের নীচে'। জি বাংলায় সম্প্রতি শুরু হয়েছে ধারাবাহিকের পুনঃসম্প্রচার। ধারাবাহিকের মুখ্য চরিত্রের অভিনেত্রী দেবলীনা দত্ত স্মৃতিমেদুর হলেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায়।
দেবলীনা জানালেন এই নিয়ে তৃতীয়বার সম্প্রচার হচ্ছে এই ধারাবাহিক অর্থাৎ প্রথম সম্প্রচার শেষ হওয়ার পরে মাসখানেকের মধ্যেই আরও একবার পুরো ধারাবাহিকটিই টেলিকাস্ট হয়। বাংলা টেলিভিশনে সম্ভবত এই ধারাবাহিকই একমাত্র যার দু'বার পুনঃসম্প্রচার হল। এই সংবাদটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বহু মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছেন সোশাল মিডিয়ায় যে লকডাউন উঠে যাওয়ার পরেও যেন ধারাবাহিকটির সম্প্রচার অব্যাহত থাকে।
আরও পড়ুন: ফিরছে ‘এক আকাশের নীচে’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, লকডাউনে নস্টালজিয়া জি বাংলায়
ঠিক প্রথম বার সম্প্রচারের সময় যে অনুভূতিটা হয়েছিল, এবারেও ঠিক তেমনই অনুভূতির মুখোমুখি, জানালেন দেবলীনা। ''আমি কালই জানতে পেরেছি আর তখন থেকেই প্রথম টেলিকাস্ট হওয়ার সেই অনুভূতিটা যেন আবার পেলাম। সেই সময়টা তো আর ফিরে পাব না। কিন্তু যে সিনটাই দেখব সেই অনুভূতিগুলো ফিরে পাব। আজ আমি যা, আমার পুরো অভিনয় কেরিয়ার-- আমি যা পারি, যা শিখেছি-- তার সবকিছুর জন্য আমি 'এক আকাশের নীচে'-র কাছে ঋণী। আমি রবি আর মিতালির কাছে ঋণী'', বলেন দেবলীনা।
রবি ওঝা প্রোডাকশন্সের এই ধারাবাহিকের চিত্রনাট্যকার ছিলেন হিন্দি টেলিভিশনের প্রথিতযশা চিত্রনাট্যকার, তাঁর স্ত্রী মিতালি। রবি-মিতালির যুগলবন্দিই বাংলা টেলিভিশনে ইতিহাস সৃষ্টি করে। ধারাবাহিকের বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মিতালি ওঝা যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি সম্ভবত দেবলীনাকে নিয়েই।
''আমি জিনাতের চরিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলাম। তখন অদিতি করত নন্দিনী। আর ওই সময় অদিতির জনপ্রিয়তা কতটা ছিল, সেটা সবাই জানেন। আমি নিজেও ওর ফ্যান ছিলাম। জিনাত ও নন্দিনীর বেশ কিছু সিন করেছি আমি আর অদিতি। জিনাতও খুব পপুলার হয়ে গিয়েছিল'', দেবলীনা জানান, ''রাস্তাঘাটে লোকে আমাকে জিনাত বলে ডাকত, আইডেন্টিফাই করত-- সেই জায়গা থেকে আমার আজও অবিশ্বাস্য লাগে যে মিতালি কীভাবে জিনাত চরিত্রের অভিনেত্রীকে নন্দিনীর চরিত্রে কাস্টিং করেছিল, কতটা কনফিডেন্স ছিল ওর। আমাকে বলেছিল যে এই নন্দিনী হিসেবে সবাই তোমাকে অ্যাকসেপ্ট করবে, আর সেটাই কিন্তু হয়।''
যখন থেকে পুনঃসম্প্রচারের কথা শুনেছেন অভিনেত্রী, অত্যন্ত মিস করছেন পরিচালক রবি ওঝাকে। জানালেন, ''কাল রাতে তিন-চার বার ঘুম ভেঙেছে, ভেবেছি রবি থাকলে কী হত। রবি যদি এখন হুইলচেয়ারে বসেও 'এক আকাশের নীচে' দেখত... ওর না থাকাটা কী সাঙ্ঘাতিক বেদনাদায়ক। মিতালির সঙ্গে কথা হয়েছে। মিতালিও খুব খুশি যে আবার দেখানো হচ্ছে সিরিয়ালটা। এতদিন ইউটিউবে প্রচুর ভিউ হয়েছে সব এপিসোডের।''
'এক আকাশের নীচে' একদিকে যেমন নারীর সমানাধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নের কথা মাথায় রেখেই পারিবারিক মূল্যবোধকে নতুন করে মূল্যায়ন করার বার্তা দিয়েছিল দর্শককে, পাশাপাশি শুটিংয়ের কিছু নতুন টেকনিকের সূচনা করেছিলেন রবি ওঝা বাংলায়। 'ওয়ান শট ওয়ান সিন' হল পরিচালক রবি ওঝার সিগনেচার, দেবলীনার ভাষায় বাংলা সিরিয়ালে তিনিই ছিলেন 'ওয়ান শট ওয়ান সিনের পায়োনিয়ার'। এই ধরনের শট নিতে হলে হ্যান্ড ক্রেন ব্যবহার করতে হয়। সেই প্রথম বাংলা সিরিয়ালের শুটিংয়ে ডিওপি আদিনাথ দাস হ্যান্ড ক্রেন ব্যবহার করেন। তাছাড়া এই ধারাবাহিকেই প্রথম অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ আরও ভালভাবে রেকর্ড করার জন্য শুটিংয়ে লেপেল ব্যবহার শুরু হয়। তার আগে সিরিয়ালের শুটিংয়ে লেপেল কেউ ব্যবহার করতেন না, এমনটাই জানান দেবলীনা।
বাংলা সিরিয়ালে দৃষ্টিনন্দন অথচ রিয়্যালিস্টিক চিত্রায়নের একটি নতুন ভাষা তৈরি করেছিল এই ধারাবাহিক। দর্শক এই ধারাবাহিক দেখতে ভালবাসতেন কারণ গোটা উপস্থাপনাটি এতটাই ঘরোয়া ছিল যে দর্শকের মনে হতো তাঁরই বাড়ির গল্প কেউ বলছেন।
''অত সহজে হয়নি জিনিসটা'', বলেন দেবলীনা, ''রবি-মিতালি আর আমাদের ডিওপি আদিনাথ, পরের দিকে রাকেশ সকলের অনেক খাটনি ছিল। আমাদের বাড়ির সিনগুলো যখন হতো, কখনও শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ পরানো হতো না, ঘুম থেকে ওঠার সিনের সময় মেকআপ করতে দেওয়া হতো না। রাতের ঘুমোতে যাওয়ার সিনে হাতের এক্সট্রা সোনার চুড়ি খুলে নেওয়া হতো। আমরা সিনটা হাতে নিয়ে দু ঘণ্টা আলোচনা করতাম, তার পরে শটে যেতাম। আর রবি শুটিংয়ের সময় সব টেকনিশিয়ানদের ফ্লোরে ডাকত। ওদের যদি সিনটা দেখে ভাল না লাগে, তাহলে রিটেক হতো। কারণ ওরাই ছিল প্রথম দর্শক। অনেকেই হয়তো জানেন তিন বছরের মাথায় কনীনিকা মানে পাখির বিয়ের পর সিরিয়ালটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু দর্শক এত চিঠি পাঠাতে থাকেন যে শেষ পর্যন্ত আবার শুরু করতে হয়। শেষের দিকটা রবি মুম্বইতে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ায় শাশ্বত ডিরেক্ট করেছিল। আমাদের সবাইকে বাড়িতে ডেকে কনসেন্ট নিয়েছিল। এটা এমন একটা জার্নি, কথা শুরু হলে শেষ হবে না, আমি বলতেই থাকব।''
বাংলা সিরিয়াল যে ক্রমশ মাস কালচার হয়ে উঠেছে, তার ভিত গাঁথা হয়েছিল যে কয়েকটি ধারাবাহিকের হাত ধরে, তার মধ্যে একটি অবশ্যই 'এক আকাশের নীচে'।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন