বাংলার ছোটপর্দার বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছেই তিনি গডমাদার। অনেকে বলেন তাঁর জহুরির চোখ। ছাইচাপা প্রতিভাকে লালন করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিতে পারেন। বাংলা ছোটপর্দায় 'গোয়েন্দা গিন্নি' অথবা 'ভুতু'-র মতো পাথব্রেকিং ধারাবাহিক রূপায়ণ করেছেন তিনি। পাশাপাশি 'পটলকুমার গানওয়ালা' অথবা 'রাগে-অনুরাগে'-র মতো আবেগ পরিপূর্ণ সোশাল ড্রামার রূপকারও তিনিই। 'ত্রিনয়নী'-র সাফল্যের পরে পর্দায় আসছে তাঁর নতুন ধারাবাহিক, 'দুর্গা দুর্গেশ্বরী'। বাংলা সিরিয়ালের সাম্প্রতিক কনটেন্টে দর্শকের নিয়ন্ত্রণ থেকে তাঁর মাতৃত্ব, সব প্রসঙ্গই এল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায়।
নতুন ধারাবাহিক 'দুর্গা দুর্গেশ্বরী'-র প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করা যাক। মা দুর্গা তো দশ হাতে সবকিছু সামলান, মা দুর্গার মতো এমন কোনও মানুষ আছে কি আপনার জীবনে, যাঁকে দেখে আপনি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন?
আমিও অনেকের মতোই মা-দিদিমার থেকেই শিখেছি। কিন্তু তার বাইরে আমি খুব একটা বড় মাদার ফিগার কাউকে পাইনি। হয়তো সেই কারণেই একটা ক্রেভিং আছে। যদি তেমন কাউকে পাওয়া যায়, যে মাথায় হাত রেখে বলবে, মা পারবি তুই... সেরকম মাদার ফিগার সত্যি বলতে কি আমি পাইনি। আমার মা ছিলেন, মা আছেন, এছাড়া আর কোনও বড় ছত্রছায়া ছিল না। কিন্তু ডেফিনিটলি তার প্রয়োজনীয়তাটা বুঝি।
আরও পড়ুন: শাশুড়ি বউমাকে নয়, বউমা বরণ করবে শ্বশুরবাড়িকে, আসছে ‘দুর্গা দুর্গেশ্বরী’
প্রফেশনাল ফিল্ডে তেমন কেউ মাথায় হাত রাখার মতো ছিল না?
প্রফেশনাল ফিল্ডে আসলে আমি সেল্ফ-মেড। সেরকম কাউকে পাইনি বলেই হয়তো চেষ্টা করি যাতে আমি নিজে তেমনটা হয়ে উঠতে পারি।
হ্যাঁ, তার আভাস পাওয়া যায় আপনার বিভিন্ন প্রজেক্টের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে কথা বলে। 'ত্রিনয়নী'-নায়িকা যেমন, আপনাকে মা বলেই ডাকেন। এটা তো একটা বড় দায়িত্ব, কখনও কি খুব চাপ মনে হয়?
না, সেটা মনে হয় না। ওরা ভালো করলে আমার খুব ভালো লাগে। আমি তো চিরকাল পিছনেই থাকি, ওরাই সামনে থাকে। ওরা যত নাম করবে ততই ভালো লাগবে আমার... একটা স্যাটিসফ্যাকশন যে ওরা ভালো করছে জীবনে। হ্যাঁ, একটা টেনশন তো হয় যে প্রত্যেকের কাজের দায়িত্ব, তাদের জীবনে বড় করে দেওয়ার দায়িত্ব... সেগুলো তো থাকবেই। যে কোনও মায়ের সেই দায়িত্ব থাকে। (হেসে) ওই জায়গা থেকে বলতে পারো যে হ্যাঁ, আমি আমার টিমের মা।
একটা প্রজেক্ট যখন শেষ হয়, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অন্য কোনও প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করতে চলে যান, তখন কি মন খারাপ হয় আপনার?
না, আমার মনে হয় ওরা বাড়ছে। ওরা কিন্তু যোগাযোগ রাখে। আমার সমস্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তার পরেও যোগাযোগ রাখে। নতুন কাজ নিলে মেসেজ করে জিজ্ঞেস করে, এটা কি করব? এই অফারটা আমার কাছে এসেছে। আমি কিন্তু সব সময় বলি না যে আমার সঙ্গে এসে কাজ কর। আমি বলি, কী চরিত্র আমাকে বল। যদি মনে হয় চরিত্রটা ভালো, আমি বলি কর। কারণ তাতে ওদের গ্রোথটা হবে। এক জায়গায় কাজ করে মানুষ থমকে যায়। কারণ শুধু আমারই কাজ যদি করতে থাকে, তাহলে তো অন্য হাউসগুলো ওদের দেখা হল না। অন্য আরও অনেক কাজ করার ধরন আছে, ধারা আছে। অন্য রাইটার আছে, ডিরেক্টর আছে। তাদের মতো করে তো দেখা হল না পৃথিবীটা। তাই ওরা অন্য কাজ নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলি, অন্যদের সঙ্গে কাজ কর, যদি ভবিষ্যতে আবার কখনও তোর মতো রোল পাই, তোকে আবার আমি ডেকে নেব। ওই সম্পর্কটা আমার সবার সঙ্গে আছে।
আপনার তো এর বাইরে একটা অন্য দায়িত্ব রয়েছে, আপনার সন্তান আছে। আপনি তো অসম্ভব ব্যস্ত। সে কি কখনও এই নিয়ে অভিযোগ জানায়?
ও আসলে জন্ম থেকে আমাকে এরকমই দেখেছে কারণ আমি তো সিঙ্গল পেরেন্ট। ও জন্মানোর ছদিনের মাথায় আমি কাজ জয়েন করেছিলাম। আমাকে করতে হয়েছিল, উপায় ছিল না। আমার ছেলে এখন ক্লাস টেনে পড়ে। ও আমার খুব বন্ধু। ওকে আমি ছোট থেকেই শিখিয়েছি, বাবা আমি চাকরি না করলে, কাজ না করলে হবে না। আমি যখন কোনও গল্প-টল্প লিখি, ও-ও মাঝেমধ্যে এসে আমাকে বলে, কোনও আইডিয়া লাগবে? ওই বন্ধুত্বটা আছে। আসলে যে সমস্ত মায়েরা ব্যস্ত হয় বা একা হয়, তাদের ছেলেমেয়েরা খুব পরিণত হয় ছোটবেলা থেকে, আমার ছেলে খুব পরিণত।
ছেলের তেমন কোনও আইডিয়া কি কখনও কাজে লেগেছিল?
আমার ছেলের আইডিয়া ঠিক বলব না কিন্তু একটা ঘটনার কথা বলি। আমার ছেলে খুব ছোট তখন, দৌড়ে বেড়ায় ঘরের মধ্যে। আমি তখন 'রমণীর গুণে' করছিলাম স্টার জলসা-য়। আমার মনে আছে 'রমণীর গুণে'-র সেকেন্ড এপিসোডে এরকম একটা সিকোয়েন্স ছিল-- পরাণদা দাদুর রোলটা করছিলেন। গ্রামে তার নৌকো ভিড়ছে, গাছের উপর থেকে নায়িকা গুলতি মারছে, দাদুর চশমায় এসে লেগে চশমাটা পড়ে যাচ্ছে। সেটা টেলিকাস্ট হওয়ার দিন রাত্রিবেলা আমি যখন বাড়িতে ফিরলাম, দরজাটা খোলার পরে আমার এইটুকু ছেলে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে আমাকে এসে বলল-- মেয়েটা দাদুর চম্মাটা ফেলে দিল, তুমি কি এটাই শেখাতে চাও? সেদিন আই ওয়াজ টেকেন আব্যাক, যে আমার সবচেয়ে বড় ক্রিটিক এসে গিয়েছে। হি হ্যাজ অলওয়েজ বিন মাই ফ্রেন্ড অ্যান্ড ক্রিটিক। ও গান ভালোবাসে খুব, গান লেখে। যখনই কোনও নতুন গান লেখে আমাকে এসে শোনায়, এরকম একটা সম্পর্ক।
আরও পড়ুন: সন্তান কি বাবা-মায়ের ইচ্ছাপূরণের পুতুল? প্রশ্ন তুলবে ‘আলোছায়া’
আপনি তো একজন ওয়র্কিং মাদার। কিন্তু আপনার ধারাবাহিকে এই রকম চরিত্র খুব কম পাই। আপনার ধারাবাহিকের বেশিরভাগ চরিত্রই কিন্তু গৃহবধূ।
আসলে কী বলো তো, ওয়র্কিং উওম্যানের যে অসুবিধাগুলো, অফিসযাত্রীর যে সমস্যা, সেগুলোর সঙ্গে তারা খুব একটা রিলেট করতে পারবে না। কারণ ধরো, তুমি কাজ করো, আমি কাজ করি, আমরা সিরিয়াল দেখি না। যাঁরা সিরিয়াল দেখেন, তাঁরা কিন্তু অফিস-কাছারি করেন না। বাড়িতে আছেন, সন্তান সামলাচ্ছেন এবং সিরিয়াল দেখছেন। তাঁরা না ঠিক করপোরেট প্রবলেম বুঝতে পারবেন না। কিন্তু আমারই সিরিয়ালে তুমি 'গোয়েন্দা গিন্নি' দেখেছ। একজন গৃহবধূর মধ্যে গোয়েন্দা হয়ে ওঠার ক্ষমতা রয়েছে। বা ধরো 'জয় কালী 'দেখেছ। তাই অন্য রকম প্রফেশনে মহিলারা যাচ্ছেন, সেটা কিন্তু আমার সিরিয়ালেই দেখা গেছে। বরং অন্য কোনও বাংলা সিরিয়ালে দেখা যায়নি।
মানে আপনি বলছেন টিপিক্যাল নটা-পাঁচটার অফিস করা নয়, সংসারের মধ্যে থেকেও নিজের একটা আইডেন্টিটি তৈরি করা, সেটা আপনার ধারাবাহিকে এসেছে বার বার। অর্থাৎ অডিয়েন্স যেরকম চাইতে পারে, সেটা মাথায় রেখে ধারাবাহিকের পরিকল্পনা করতে হয়, তাই তো?
কিছুটা তো করতেই হয়।
বাংলা টেলিভিশনের কনটেন্ট কেমন হবে, সেটা দর্শক কতটা নিয়ন্ত্রণ করছে? খুব বেশিমাত্রায় কি?
দেখো যতদিন তুমি টিআরপি-র মাপকাঠিতে বিচার করবে, ততদিন তো কন্ট্রোল করবেই। কিন্তু আমি এটাও বলব... ধরো 'গোয়েন্দা গিন্নি', ওরকম কনসেপ্ট আগে হয়নি। লোকে অসম্ভব ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। কী করে করল যদি দর্শকই সবটা কন্ট্রোল করে? ভালো কনটেন্ট দিলে তো অ্যাকসেপ্ট করবেই। বা ধরো 'ভুতু'-- একটা বাচ্চা ভূত, তাকে নিয়ে সিরিয়াল হয়েছে, সেটা তো আগে কেউ ভাবতেও পারেনি। যে সময়ে টিপিক্যাল সাঁস-বহু টাইপের সিরিয়াল হচ্ছে বা 'সাত ভাই চম্পা' ধাঁচের সিরিয়াল হচ্ছে, সেই সময় তো 'জয় কালী' হই হই করে চলেছে। তাই অন্য রকম কনটেন্ট দিলে যে দর্শক নেবেন না, এমনটা কিন্তু নয়। যদি তুমি ভালো করে তাদের কাছে পরিবেশন করতে পারো এবং যদি চরিত্রটাকে ভালোবাসাতে পারো তবে দর্শক অবশ্যই গ্রহণ করবেন। আর ওটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটাগনিস্টকে ভালোবাসাতে পারতে হবে, না হলে কোনও চরিত্রই ক্লিক করবে না, যত বড় চরিত্রই হোক না সেটা।