"জীবে প্রেম করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর…", বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। আর সেই জীবকূলেই কিনা অন্তর্দন্দ্ব! মানুষে মানুষে হানাহানি, রক্তপাতের ঘটনা সভ্য সমাজের মজ্জায় সয়ে গেলেও অবলা চারপেয়েগুলোর হয়ে কিন্তু আওয়াজ তোলেন খুব কম মানুষই। বরং, নিত্যদিন পাড়ার লালু-ভুলুদের কপালে জোটে দূর-দূর, ছাই-ছাই…। এমনকী আক্রান্ত হচ্ছেন পশুপ্রেমীরাও। রুখবে কে? প্রতিবাদ হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। কখনও বা প্রসাশনিক কর্তা-ব্যক্তিদের মর্মে পশে তারকাদের সুবাদে। কিন্তু আদৌ কি কোনও লাভ হচ্ছে? টলিউডের তারকারা বলছেন, পথপশুদের ওপর এই আক্রমণ ঠেকাতে কড়া আইন দরকার। পাশাপাশি পশুপ্রেমীদের ওপর আক্রমণের ঘটনাতেও তাঁরা বেজায় ক্ষিপ্ত।
দিন কয়েক আগে শ্রীলেখা মিত্রর (Sreelekha Mitra) আবাসনেই এমন ঘটনা ঘটেছে। আদর করে এক অবলা চারপেয়েকে রাস্তা থেকে তুলে এনে আদর-আত্তি করছিলেন নায়িকা। তাঁর বাড়িতে অবশ্য এরকম অনেকেই আছে। ভাল মনে নেননি তাঁর আবাসনের প্রতিবেশীরা। বরং কড়া ভাষায় কথা শুনিয়েছেন। এমন অপমান-লাঞ্ছনার শিকার অবশ্য আগেও হতে হয়েছে অভিনেত্রীকে। আরেক মহিলা আইনজীবীও হেনস্তার শিকার হয়েছেন দিন কয়েক আগে খাস কলকাতার বুকে।
শ্রীলেখা বলছেন, "সেদিন ফেসবুক লাইভে এসে ঝরঝর করে কেঁদেছিলাম। মনে হয়েছিল, এই সমাজে হয়তো আমি বা আমার মতো মানুষ থাকার যোগ্য নই। আমার সব কুকুরগুলোর ভ্যাকসিন নেওয়া, অ্যান্টি-রেবিস নেওয়া, তারপরও লোকজনের অপমানের শেষ নেই। এত অবলা প্রাণীগুলো নাকি ওদের কামড়ে-আঁচড়ে দেবে! এমনকী ওদেরকে বিষ খাইয়ে মারার কথাও বলা হয়েছে। তবে এত কাণ্ডর পর আমি থেমে যাইনি। বরং আইনি পথে হেঁটেছি।" দুটো সিনেমার রিলিজ সামনে। সেগুলোর প্রচারের মাঝেই অভিনেত্রী বর্তমানে থানা-পুলিশ দৌড়োদৌড়ি করছেন। সর্বক্ষণ কথা বলছেন আইনজীবীর সঙ্গে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার কাছে জানালেন নিজেই।
ইন্ডাস্ট্রির আরেক তারকা ইমন চক্রবর্তীও (Iman Chakraborty) বেজায় চটেছেন। অবলা প্রাণী। নেই নিরাপদ আশ্রয়। খাবারের খোঁজে ইতি-উতি ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। আর সেই অসহায় চারপেয়েগুলোর ওপরই যথেচ্ছার চলছে যত্র-তত্র। গর্জে উঠলেন গায়িকা। ইমনের কথায়, "রাস্তায় সিগারেট খাওয়া যাবে না কিংবা হেলমেট না পরে রাইড করলে ঠিক যেরকম জরিমানা করা হয় প্রশাসনের তরফে। আমার মনে হয়, এক্ষেত্রেও কঠোর আইন আনা উচিত সরকারের অতি সত্ত্বর। পথপশুদের অত্যাচার করলেই যে মুহূর্তে ২০০-১০০ টাকা জরিমানা নেওয়া শুরু হবে, তখনই দেখবে লোক আর এসব অমানবিক আচরণ করছে না।
<আরও পড়ুন: ‘২০১৪-তে স্বাধীন হয়েছে ভারত’, কঙ্গনা! ‘পাগলের প্রলাপ’ খোঁচা সাংসদ বরুণ গান্ধির>
প্রসঙ্গত, ইমন নিজেও পথসারমেয়দের দেখাশোনা করেন। আম্ফানের সময় স্থানীয় লোকজনদের নিয়ে রাস্তা থেকে বহু কুকুরকে উদ্ধার করে তাঁর নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। জল-খাবারও দিয়েছিলেন। এরপরই গায়িকা জানালেন, "আমার বাড়িতেও একটি পথকুকুর থাকে। একটা ল্যাব আছে। আমি নিজেও ব্যস্ত থাকি। ঠিক করে দেখাশোনা করতে পারব না বলে দিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো কেউ নেয়নি। শুধুমাত্র একটা দেশী কুকুর বলে। পথপশু নিয়ে লোকের মধ্যে আরও সচেতনতা বাড়া দরকার। সরকারের কড়া আইনি পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনও পথ দেখতে পাচ্ছি না।"
পথকুকুরদের গায়ে কোথাও ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে গরম জল। আবার কোথাও বা উৎসবের মরসুমে অমানবিক উল্লাসে মেতে ওঠার জন্য ওদের পায়ে-লেজে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে বাজি। এই তো দীপাবলির রাতের ঘটনা। খড়্গপুরে এক পথ সারমেয়র পা থেকে উরু অবধি সমস্তটা উড়ে গিয়েছে বাজির তাণ্ডবে। কিন্তু শুধু যে তাঁরাই এধরণের অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন এমনটা নয়! বরং পথপশুদের সেবা যাঁরা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত তাঁদেরও আক্রান্ত হতে হচ্ছে প্রতিবেশীদের কাছে।
শ্রীলেখা মিত্রর আবাসনের কথা উল্লেখ করে অভিনেতা সৌরভ দাস (Sourav Das) বলছেন, "লাইভটা দেখলাম। পথকুকুরদের নিয়ে আপত্তি থাকতেই পারে, কিন্তু প্রতিবাদ করার এটা কোনধরণের ভাষা? কেউ ক্যামেরার সামনে এসে নেচে কথা বলছেন। কেউ হাত-পা ছুঁড়ছেন। তাছাড়া, অসুস্থ কুকুর ছাড়া কোনও পথকুকুর কামড়ায় বলে তো শুনিনি, দেখিওনি। সমস্যা থাকলে কমপ্লেক্সের কমিটিকে জানাক। কী অসুবিধে সেগুলো লিস্ট করে দিক। সেসব দেখেশুনে বিচার করা হবে। কিন্তু পথপশু কিংবা পশুপ্রেমীদের যেভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে, সেটার বিরুদ্ধে সরকারের তরফে একটা কঠোর আইন আনা উচিত।"
পরিচালক-অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায় (Tathagata Mukherjee) বলছেন, "খড়্গপুরের আক্রান্ত কুকুরটির চিকিৎসার দেখভালের সমস্ত খবরই রাখছি। গত ৫ বছর ধরে আমি, দেবলীনা, দময়ন্তী, আমাদের মতো কয়েকজন পথসারমেয়দের নিয়ে সচেতনতা প্রচার চালিয়েছি। অনেকটা কাজও হয়েছে। কিন্তু শ্রীলেখাদির আবাসনের ঘটনাটা বিচ্ছিন্ন। অবাঙালিরা মূলত গুজরাত, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ থেকে যাঁরা এসে কলকাতায় বাস করা শুরু করে তাঁদের মধ্যে এহেন বৈষম্যমূলক ভাবনা-চিন্তা বাসা বেঁধে রয়েছে। এর আগে হাইল্যান্ড পার্কের এক আবাসনেও এমন এক ঘটনা দেখেছি। অবাঙালিদেরই মূলত পথকুকুরদের নিয়ে বেশি আপত্তি তুলতে দেখেছি। কলকাতার মানুষের ভাবনা কিন্তু পথপশুদের নিয়ে অনেকটাই বদলে গিয়েছে গত ৬-৭ বছরে। বিশেষ করে লকডাউনের সময় দেখলাম, অনেকেই বাড়ির বাইরে বেরিয়েছেন শুধুমাত্র কুকুরদের খাওয়াবেন বলে।"
তথাগত যোগ করলেন, "কলকাতার কালচারে যাঁরা বড় হয়ে ওঠেননি, তাঁদের মধ্যেই এই সমস্যাগুলো বেশি দেখেছি কাজ করতে গিয়ে। বাইরের রাজ্য থেকে আসা লোকগুলোর মধ্যে ভাতৃত্ববোধের অভাব আসলে। তাঁরা ব্যবসায়ী চিন্তা-ভাবনার। শিক্ষার অভাব। বাড়ির পরিচারকদেরও এক পয়সার জন্য চড় মারতে যারা দুবার ভাবেন না, তারা পথকুকুরদের পেট ভরাবেন এটা কি করে আশা করা যায়? কমপ্লেক্সের ভিতরে ওই ডগ হেটারস গ্রুপটা এঁরাই তৈরি করেন।"
পাশাপাশি অভিনেতা-পরিচালক জানান, ডায়মন্ড সিটিতে ২০১৫ সালে একসঙ্গে ১৬টা কুকুরকে পিটিয়ে মারা হয়। "তখন আমি ওখানে থাকতাম। দেবশ্রীদি (রায়) প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন বলে, ওঁর সঙ্গেও প্রচণ্ড অভব্য আচরণ করা হয়। কমপ্লেক্সগুলোতে মূলত অবাঙালিরাই গোলমাল বাঁধান পথকুকুরদের নিয়ে। কলকাতার বেশিরভাগ পাড়ায় কিন্তু আজকাল এহেন ঘটনা খুব কমই দেখা যায়। বিশেষ করে, নবীন প্রজন্মকে দেখি পথকুকুরদের বিষয়ে খুব সচেতন তাঁরা।"
ছোটপর্দার রানিমা ওরফে দিতিপ্রিয়া রায় (Ditipriya Roy) সমস্ত পশুপ্রেমীদের একজোট হওয়ার কথা বলছেন। শ্রীলেখার মতো যাঁরাই পথপশুদের সেবা করে আক্রান্ত হচ্ছেন, সেই বিষয়টিরও তীব্র নিন্দা করেছেন তিনি।
আরেক টেলি-নায়িকা রূপসা চট্টোপাধ্যায় (Rupsa Chatterjee) বলছেন, "রাস্তার কুকুরদের ভালবাসতে না পারেন, দরকার নেই। কিন্তু যাঁরা কুকুরদের সেবা করছেন, খেতে দিচ্ছেন, মাথা গোঁজার ঠাঁই দিচ্ছেন, তাঁদের অহেতুক কেন বিরক্ত করছেন?"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন