ছোটপর্দা বা বড়পর্দা সাহিত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এবং রবীন্দ্রসাহিত্যের ক্ষেত্রে তা বারবার ঘটবে, সেটাই কাম্য। রবি ঠাকুরের বিপুল সাহিত্য়ভাণ্ডারের কতটুকুই বা বাংলা অথবা জাতীয় স্তরের চলচ্চিত্রে বা টেলিপর্দায় এসেছে? অনেক ক্ষেত্রেই আবার দেখা গিয়েছে যে একই টেক্সট নিয়ে একাধিকবার কাজ হয়েছে, অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু টেক্সট নিয়ে নাড়াচাড়া করতে সেভাবে কেউ সাহস পান নি। তবে তুলনামূলকভাবে চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে কাজ বেশি হয়েছে। ছোটপর্দা এক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে থাকলেও বাংলা ও হিন্দি টেলিভিশন মিলিয়ে পাঁচটি উল্লেখযোগ্য কাজের কথা বলাই যায়, যেগুলির দিকে মাঝেমধ্যে ফিরে তাকাতে বহু দর্শকেরই ভাল লাগে।
আরও পড়ুন: থিয়েটারে মুক্তধারা…রবীন্দ্র ঠাকুর!
বাংলা টেলিভিশনের গোড়ার দিকে, দূরদর্শন-ই যখন ছিল বাঙালি দর্শকের একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম, তখন রবি ঠাকুরের প্রায় সব নৃত্যনাট্যই দেখা গিয়েছে পর্দায়। পাশাপাশি, 'চিরকুমার সভা', 'শেষরক্ষা', 'স্বর্গীয় প্রহসন' ইত্য়াদি নাটকের টেলি-প্রযোজনার কথাও অনেকেরই হয়তো মনে আছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে বাংলা দূরদর্শনে রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল 'গল্পগুচ্ছ' ও 'গোরা'। অভিনেতা জর্জ বেকার-কে গোরা চরিত্রে গ্রহণ করা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে বেশ মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেই সময়ে। তা সত্ত্বেও সীমিত পর্বের ধারাবাহিক হিসেবে সম্প্রচারিত উপন্য়াসের ওই টেলি-প্রযোজনাটির ভিউয়ারশিপ ছিল বেশ ভাল।
এর অনেক বছর পরে ২০১২ সালে, জাতীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয় হিন্দি ভাষায় নির্মিত 'গোরা'। ২৬ এপিসোডের এই ধারাবাহিকের প্রযোজক ছিলেন গার্গী সেন ও পরিচালক সোমনাথ সেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি দর্শক এই সিরিজটির খুব একটা খোঁজ রাখেন নি। যদিও বাংলার বেশ কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী ওই সিরিজে অভিনয় করেন। গোরা-র ভূমিকায় ছিলেন বলিউড-অভিনেতা গৌরব দ্বিবেদী।
তবে হিন্দি টেলিভিশনে এখনও পর্যন্ত রবি ঠাকুরকে নিয়ে সেরা কাজ, অনুরাগ বসু-র 'স্টোরিজ অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর'। এপিক চ্য়ানেলের জন্য় নির্মিত এই সিরিজটির প্রথম সিজনের ২৬টি এপিসোড সম্প্রচারিত হয়। 'চোখের বালি', 'অতিথি', 'নষ্টনীড়', 'কাবুলিওয়ালা'-সহ একাধিক উপন্য়াস ও গল্পকে অত্য়ন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে টেলিপর্দায় নিয়ে এসেছিলেন পরিচালক। ২০১৫ সালে সম্প্রচারিত এই সিরিজটির কথা রবীন্দ্র-অনুরাগী দর্শক এখনও আলোচনা করেন।
ওই বছরই বাংলা টেলিভিশনে একটি উল্লেখযোগ্য় কাজ হয় রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে। অভিজিৎ গুহ-সুদেষ্ণা রায় পরিচালিত 'রবি ঠাকুরের গল্প' সম্প্রচারিত হয় কালারস বাংলা-তে। প্রত্যেকটি গল্পেরই তিনটি করে এপিসোড ছিল। 'দেনাপাওনা', 'সমাপ্তি', 'কাবুলিওয়ালা', 'পোস্টমাস্টার', 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন', 'মণিহারা', 'জীবিত ও মৃত', 'মধ্য়বর্তিনী', 'মানভঞ্জন', 'নষ্টনীড়', 'স্ত্রীরপত্র', 'নৌকাডুবি' এবং 'চোখের বালি' - রবীন্দ্র সাহিত্য়ের সবচেয়ে বেশি আলোচিত গল্প-উপন্যাসগুলি টেলিপর্দায় উপস্থাপিত হয়। বাংলা টেলিজগতের জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কাজ করেছিলেন এই সিরিজে।
রবীন্দ্রসাহিত্য়ের বিপুল ভাণ্ডারে, ছোটপর্দা ও বড়পর্দা মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে সম্ভবত 'চোখের বালি' নিয়ে। বড়পর্দার প্রসঙ্গটা না হয় বাদ রইল। ছোটপর্দায় এই উপন্যাস নিয়ে বহু বার সীমিত সংখ্য়ার সিরিজ নির্মিত হয়েছে। তবে ২০১৬ সালে সম্প্রচারিত জি বাংলা-র ধারাবাহিকটি দর্শকের স্মৃতিতে এখনও তাজা। মিলেনিয়াম-পরবর্তী সময়ে, বেসরকারি বাংলা বিনোদন চ্য়ানেলের রমরমার যুগে, জি বাংলা-র ওই ধারাবাহিকটিই রবীন্দ্রসাহিত্য়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য় চিত্রায়ণ বাংলা টেলিপর্দায়।
আরও পড়ুন: 'শেষের কবিতা'র পরে কী! একই বিষয়ে দু’টি ছবি, অবাক পরিচালকেরা
বাংলা টেলিভিশনের দর্শকের মধ্য়ে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল ধারাবাহিকটি। এই প্রসঙ্গে একবার জি বাংলার বিজনেস হেড সম্রাট ঘোষ জানিয়েছিলেন, ধারাবাহিকটি সম্প্রচারের পরে বহু দর্শক জানতে পারেন যে 'চোখের বালি' আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উপন্যাস, ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি নয়। টেলিপর্দা যে শুধুই বিনোদন দেয় না, সাধারণ জ্ঞানের নিরিখে পিছিয়ে থাকা বহু দর্শককে যে অনেকটা তথ্যসমৃদ্ধ করে তোলে এই মাধ্য়ম, 'চোখের বালি' তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
টেলিপর্দায় রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায় আকাশ বাংলা-র 'সাহিত্য়ের সেরা সময়' এবং পরবর্তী সময়ে আকাশ ৮-এর 'এক মাসের সাহিত্য' সিরিজের কথা না বললে। প্রায় দু'দশক ধরে বাংলা সাহিত্যকে টেলিপর্দায় নিয়ে আসার কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছে চ্য়ানেল এইট। সেখানে রবীন্দ্রসাহিত্য বারবার উপস্থাপিত হয়েছে। রবি ঠাকুরের জনপ্রিয় উপন্যাস-গল্পগুলির মধ্য়ে খুব কমই রয়েছে যা এই সিরিজে প্রদর্শিত হয়নি।
এর পরেও বলা যায়, রবীন্দ্রসাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডারের সম্ভবত অর্ধেকও ধরা পড়েনি ভারতীয় টেলিমাধ্যমে এবং আগামী দিনে এই অনুপাত বাড়বে কি না সেই নিয়ে বেশ সন্দেহ রয়েছে।