সাল ১৯৪৭, স্বাধীনতা আসন্ন। বাইশ বছরের এক যুবক একটি গান লিখে তাতে সুর দিলেন। ১৯৪৩-এর ভয়াবহ মন্বন্তরের অতিবিবর্ণ রূপ তাঁকে চাক্ষুষ দেখতে হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার পর তিন বছর শহর-গ্রাম-মফস্বল ঘুরে ঘুরে ব্রিটিশ প্রশাসন এবং নির্মম পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বার্তা বিপ্লবী সঙ্গীতের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়ে সঙ্গীত রচনার কাজটা তাঁর ততদিনে রপ্ত হয়ে গেছে; ১৯৪৪-এ ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনে (আইপিটিএ) যোগ দিয়ে দলের এক উৎসর্গীকৃত সদস্য হয়ে উঠেছেন। যুবকের নাম সলিল চৌধুরী।
পূর্বলিখিত বিশেষ গানটি গাওয়ার জন্য তিনি ধরলেন এক বন্ধু তথা আইপিটিএ-র সহ-সদস্যকে, যিনি দীর্ঘদিন ধরেই পিতার নিরন্তর আপত্তি সত্ত্বেও পেশাদার সঙ্গীতকার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। চোদ্দ বছর বয়সেই আকাশবাণীর জন্য প্রথম গান গেয়েছিলেন, যার উত্তরকালীন কিছু বছরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক হিসেবে কিঞ্চিৎ নামও হয়েছিল তাঁর। বন্ধুর নাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সলিলের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন হেমন্ত, যার ফলে সৃষ্টি হলো 'গাঁয়ের বধূ' নামে অবিস্মরণীয় সেই গান। গানের গঠন, বিন্যাস, এবং বিষয়বস্তু থেকে ঝরে পড়ছিল অভিনবত্ব। ঝরে পড়ছিল দুই সদ্য আবিষ্কৃত তারকার প্রতিভাও।
এই একই সময়ে নবাগত অভিনেতা অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় নাটকের মঞ্চ থেকে বেরিয়ে চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করছিলেন। 'মায়াডোর' বলে একটি ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ জুটল বটে, কিন্তু ছবিটি মুক্তির আলো দেখল না। পরিচালক নীতিন বসুর ১৯৪৮ সালের ছবি 'দৃষ্টিদান'-এও অভিনয় করলেন তিনি, যার শুভ মুক্তিও হলো (আজ এটিকেই তাঁর প্রথম ছবি বলা হয়); কিন্তু গণপ্রতিক্রিয়া বা ছবির ব্যবসা তেমন শুভ হলো না।
আরও পড়ুন: মুছে যাওয়া দিনগুলি: শতবর্ষ শেষে হেমন্তের জীবনের জানা-অজানা মুহূর্ত
নিরাশ না হয়ে অরুণ নিষ্ঠা সহকারে করে ফেললেন আরও কয়েকটি ছবি, প্রত্যেকটিতেই ডুবল প্রযোজকের টাকা। স্টুডিও পাড়ায় অরুণ হয়ে উঠছিলেন উপহাসের পাত্র; কেউ কেউ 'ফ্লপ মাস্টার' নামেও ডাকতে শুরু করেছিলেন। ব্যর্থতাবোধ এবং সম্ভাব্য বেকারত্বের ভয় অরুণকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল মানসিক অবসাদের দিকে। অভিনয় শুরু করার আগে কলকাতা বন্দরে যে কেরানির কাজ করতেন, স্থির করলেন, সেই চাকরিতেই ফিরে যাবেন। বাদ সাধলেন স্ত্রী গৌরী দেবী। স্বামীকে কিছুতেই হাল ছাড়তে দিলেন না, এবং অরুণের যাত্রায় শীঘ্রই এল ঘূর্ণিপাক। উপর্যুপরি তিনটি ছবি বক্স-অফিসে ঢেউ তুলল: 'বসু পরিবার' (১৯৫২), 'সাড়ে চুয়াত্তর' (১৯৫৩), এবং 'অগ্নিপরীক্ষা' (১৯৫৪)। দেখতে দেখতে 'ফ্লপ মাস্টার' হয়ে গেলেন ভবিষ্যতের সুপারস্টার, এবং অরুণ চট্টোপাধ্যায় হলেন উত্তমকুমার।
বলা হয়, উত্তমকুমারের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম আলাপ ১৯৫৫-য়, 'শাপমোচন' ছবিতে কাজ করতে গিয়ে। কিন্তু, এই বিষয়ে কিঞ্চিৎ বিতর্ক আছে। গবেষক সুশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫১ সালে 'সহযাত্রী' নামক ছবিতে নাকি হেমন্ত উত্তমের জন্য একটি গান গেয়েছিলেন, কিন্তু সেই ছবির সমস্ত প্রিন্ট আজ বিলুপ্ত, কাজেই এই তথ্য যাচাই করে দেখার উপায় আপাতত নেই। তবু, যদি ধরে নেওয়া হয় যে ১৯৫৫-তেই দুজনের সম্পর্কের সূত্রপাত হয়, তবে এটা বলা চলে যে তাঁদের কর্মজীবনের গ্রাফ ততদিনে প্রবলভাবে ঊর্ধ্বমুখী। উত্তমকুমার তখন বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় উদীয়মান তারকাদের মধ্যে একজন। রবীন্দ্রসঙ্গীত মহলে হেমন্তকে পঙ্কজ মল্লিকের উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হচ্ছে, এবং ১৯৫১ সালে পরিচালক হেমেন গুপ্তর আহ্বানে স্থানপরিবর্তন করে তাঁবু গেড়েছেন বম্বেতে। 'আনন্দমঠ' (১৯৫২), 'জাল' (১৯৫৪), এবং 'নাগিন' (১৯৫৪) হিন্দী চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে তাঁর কিছু বিখ্যাত ছবি।
'শাপমোচন'-এর জন্য পরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে চেয়েছিলেন শচীন দেববর্মণকে, এবং তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে তাঁর সম্মতি চাইতে সুধীরবাবু বম্বে যান। পরিস্থিতি নিশ্চয়ই আশাপ্রদ ছিল, নাহলে তিনি স্বয়ং অতদূর চলে যেতেন না, কিন্তু অন্যান্য ব্যস্ততার কারণে রাজি হতে পারলেন না শচীন দেববর্মণ। ইতিমধ্যে হেমন্ত জানতে পেরেছেন যে সুধীরবাবুর প্রস্তাবে মত দেন নি শচীন কর্তা। কলকাতায় ফিরে যাওয়ার মতো একটা কাজের সন্ধানে ছিলেন হেমন্ত, এবং সেই ছুতোয় সুধীরবাবুর সঙ্গে দেখা করে ফেললেন। পরের দিন সুধীরবাবু হেমন্তকে পাকাপাকিভাবে নিযুক্ত করলেন, এবং হেমন্ত ফিরে এলেন তাঁর প্রাণের শহরে।
আরও পড়ুন: শতবর্ষে ফিরে দেখা হেমন্তের শ্রেষ্ঠ গানের ডালি
সুধীরবাবু কী প্রত্যাশা করেছিলেন বলা মুশিকল, কিন্তু ছবিতে উত্তমের স্বতঃস্ফূর্ততা ও গাম্ভীর্যের মিশ্রণ হেমন্তের মোহন সুরে খুঁজে পেয়েছিল এক অনবদ্য প্রতিফলন। 'সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা' বা 'ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস'-এর মতো গান আজও শ্রোতার মনে কালবৈশাখী ঝড় তুলতে পারে, যেমন তুলেছিল তৎকালীন শ্রোতা-দর্শকের মনে।
অনেক সময়ে দেখা যায়, একজন গায়কের বাচনকণ্ঠ (speaking voice) আর তাঁর গানের কণ্ঠ (singing voice) পৃথক; কিন্তু এই ক্ষেত্রে, কথা বলার সময়েও হেমন্ত এবং উত্তমের কণ্ঠস্বরের অলৌকিক মিল ছিল। এটা প্রমাণ হয়ে যায় ১৯৫৭-র 'হারানো সুর' ছবিতে, যার একটি দৃশ্যে উত্তমের চরিত্র নাম ধরে ডাকছে সুচিত্রা সেনের চরিত্রকে; ডাবিংয়ের সময়ে কোনও কারণে অনুপস্থিত ছিলেন উত্তম, সুতরাং ছবিতে সেই ডাক দিলেন হেমন্ত। যা বাকি সংলাপের সঙ্গে অবলীলায় মিশে গেল।
বলাই বাহুল্য, দীর্ঘদিনের রুপোলি পর্দার এই অবিচ্ছেদ্য জুটি ব্যক্তিগত জীবনেও ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে উঠেছিলেন। জানা যায়, হেমন্ত নিজে গিয়ে আশ্বাস না দিলে উত্তম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের 'মহিষাসুরমর্দিনী'-র সেই এক বছরের হতভাগ্য বিকল্প অনুষ্ঠান 'দেবী দুর্গতিহারিণী'-তে অংশগ্রহণ করতে রাজি হতেন না। একটা সময়ে তাঁদের বৃত্তিগত এবং ব্যক্তিগত জীবনও মিশে একাকার হয়ে গেছিল, এমন বলাই যায়।
তবে এই মিশ্রণ বেশিদিন অবলীলায় টিকতে পারেনি। সুধীরবাবুরই ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি 'দুই ভাই'-এ 'তারে বলে দিও'-র মতো উপহার শ্রোতাদের দেওয়ার পর থেকেই কমতে থাকে উত্তমের প্লেব্যাকে হেমন্তর কণ্ঠস্বরের ব্যবহার। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে উত্তমের ছবিতে কাজ করতে থাকেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যবধান বাড়তে থাকে। এই সময়ে উত্তমের চরিত্রের নেপথ্যকণ্ঠী হিসেবে শোনা যায় শ্যামল মিত্র এবং মান্না দে'র মতো সুপ্রতিষ্ঠিত গায়কদের। যে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে যেতেন উত্তম-হেমন্তর যুগলবন্দি শুনতে, সেই দর্শকই তাঁদের মধ্যে একাধিক বচসার খবর পেতে লাগলেন।
এই দ্বন্দ্ব, দূরত্ব কী কারণে শুরু হয়, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। সবটাই অনুমান-জল্পনার জালে জড়িয়ে। বলা হয়, একটা বড়সড় বিবাদ সৃষ্টি হয় উত্তম এবং গৌরী দেবীর বিবাহবার্ষিকীর আসরে। হেমন্ত নাকি গৌরী দেবীকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ছলে এমন কিছু কথা বলেন যা উত্তমের অপমানজনক এবং কুরুচিকর বলে মনে হয়। এটাও শোনা যায় যে কিছু বছর পর অভিনেত্রী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে আরেক গুরুতর কলহ শুরু হয়। হেমন্ত এবং উত্তম, দুজনেই নাকি নিজেদের পুত্রদের সঙ্গে মৌসুমীর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এবং মৌসুমী উত্তম-পুত্র গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের প্রস্তাব নাকচ করে হেমন্তর ছেলে জয়ন্তকে বেছে নেন শেষমেশ। গৌতম এবং উত্তমের পক্ষে এই 'পরাজয়' মেনে নেওয়া সহজ হয় নি।
মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, এই সব কাহিনীর বৈধতা কখনোই যাচাই করা হয়নি। জীবনকালে তাঁদের সম্পর্কে কবে কখন পথের কাঁটা দেখা দিয়েছিল, তা গণনা করার চেষ্টা বৃথা। তার চেয়ে, 'সপ্তপদী' (১৯৬১), 'নায়িকা সংবাদ' (১৯৬৭), 'সাথীহারা' (১৯৬১), 'বন্ধু' (১৯৫৮), এবং উত্তমকুমারের এমন আরও অনেক ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অবদান কতটা তাৎপর্যপূর্ণ, সেটাই আরেকবার স্মরণ করে নিই। তাঁদের দৌলতে বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গীত যতটা সমৃদ্ধ হয়েছিল, ততটা জোর তাঁদের মনোমাালিন্যে সম্ভবত ছিল না।
উত্তমকুমার ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই দেহত্যাগ করেন। দেশজুড়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন অনেকেই, কিন্তু বহুদিন হেমন্ত এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেন নি। অবশেষে তাঁর নিজের প্রয়াণের কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে উত্তম সঙ্গে করে নিয়ে যান তাঁর নিজের অন্তরের এক মস্ত অংশ। হেমন্তর প্রয়াণ হয় ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। আমাদের সঙ্গীতের কিংবদন্তী নক্ষত্র নিশ্চয়ই সুরের আকাশে এক ধ্রুবতারার স্থান পেয়েছেন; উত্তমও বেশি দূরে নেই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন