Star Jalsha Sreemoyee: টেলিপর্দায় দর্শক পারিবারিক গল্প দেখতে ভালবাসেন কারণ এদেশে এখনও টিভি দেখার অভ্যাসটা সপরিবারে। খুব কম পরিবারই রয়েছে যেখানে সদস্যরা নিজের নিজের ঘরে একা টিভি দেখেন। এদেশের বেশিরভাগ টিভি-দর্শকের কাছে ধারাবাহিকের পরিবার, বাড়ি-ঘর যেন তাদের বসার ঘর অথবা উঠোনেরই অংশ। যেহেতু ধারাবাহিকের চরিত্রগুলি প্রত্যেকদিনই পর্দায় আসে, তাই একটা সময় পরে দর্শক এই চরিত্রগুলিকে পরিবারের অংশ মনে করতে শুরু করেন।
বহু টেলি-অভিনেতা-অভিনেত্রীই একাধিকবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে গ্রামে-গঞ্জে যখন তাঁরা স্টেজ শো করতে যান, তখন দর্শক এসে তাঁদের ঘরের মেয়ে বা ঘরের ছেলে বলেই সম্বোধন করতে ভালবাসেন। আবার যাঁরা নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করেন, তাঁদের অনেক সময়েই বকুনি শুনতে হয়, সমালোচনা শুনতে হয়। আসলে চিত্রনাট্য-শ্যুটিং-কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজি এসব কিছুই তাঁরা বোঝেন না। তাঁদের কাছে শুধুই থাকে কয়েকটি চরিত্র ও তার জার্নি।
আরও পড়ুন: শীর্ষে আবার ‘রাসমণি’, দ্বিতীয় ‘কৃষ্ণকলি’
'শ্রীময়ী' সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা টেলিভিশনে একটা অসামান্য জার্নি তৈরি করেছে। ঠিক যেমনটা দেখা গিয়েছিল অপর্ণা সেনের ছবি 'পরমা' (১৯৮৫)-তে। তবে পরমার ক্রাইসিস ও শ্রীময়ীর ক্রাইসিস অনেকটাই আলাদা। কিন্তু পরমা যে গন্তব্যে পৌঁছয় ছবির শেষে, শ্রীময়ী সম্প্রতি সেই গন্তব্যে পৌঁছেছে। একটি অসুখী দাম্পত্য থেকে বেরিয়ে, একা মাথা উঁচু করে বাঁচার অঙ্গীকার করেছে।
আগামী সপ্তাহগুলিতে শ্রীময়ী আরও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেবে যা নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক-- সে তার স্ত্রীধন তুলে দেবে জুনের হাতে। বিয়ের সময় মহিলাদের যে গয়না উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হয়, সেগুলিকে বলে স্ত্রীধন। ভারতীয় আইন অনুযায়ী, এই স্ত্রীধনের উপর একজন মহিলার একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে। তিনি নিজে উপহার বা দান না করলে, এই গয়নাগুলি কোনওমতেই তাঁর থেকে নিয়ে নেওয়া যায় না।
বেশিরভাগ মহিলারাই বিবাহবিচ্ছেদের পরে স্ত্রীধন নিজের কাছে রাখেন। অনেকে তা রাখতে বাধ্য হন আর্থিক নিরাপত্তা বা ভবিষ্যতের জন্য। আবার এমন নিদর্শনও বিরল নয় যে ভরণপোষণের পাশাপাশি স্ত্রীধনও অস্বীকার করেছেন বহু মহিলা। আত্মসম্মান বজায় রেখে, নিজের কর্মদক্ষতার উপর আস্থা রেখে, স্ত্রীধনের অধিকার ছেড়ে দিয়েছেন।
ঠিক তেমনই একটি পদক্ষেপ নিতে চলেছে শ্রীময়ী। এই চরিত্রটিকে চিত্রনাট্যকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায় এমন একটি উত্তরণে নিয়ে যেতে চাইছেন, যা এই সময়ে খুব প্রয়োজনীয়। এই প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে দেওয়া লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন একটি চলতি প্র্যাকটিসের কথা। ২০১৯ সালে যখন মহিলারা সরব মিটু আন্দোলন নিয়ে, বডি শেমিং অথবা স্লাট শেমিং নিয়ে, যে সময় যৌন হেনস্থা নিয়ে প্রকাশ্যে বা সোশাল মিডিয়ায় কথা বলতে মেয়েরা আর লজ্জাবোধ করে না, সেই সময়ে দাঁড়িয়েও বহু মেয়ে মনে করে যে রেস্তোরাঁর বিল পেমেন্ট করার দায়িত্ব তার পুরুষ সঙ্গীটিরই। সে স্বামীই হোক অথবা বয়ফ্রেন্ড।
আরও পড়ুন: শুভজিৎ-শ্যামোপ্তি-ইন্দ্রজিৎ! আসছে নতুন ধারাবাহিক
হয়তো অনেকে তলিয়ে ভেবেই দেখেন না। কিন্তু তলিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে, সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলি। তাই 'শ্রীময়ী'-র মতো ধারাবাহিক সত্যিই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় টেলিভিশনের মতো মাস মিডিয়ায়। পশ্চিমবঙ্গের যে প্রান্তে বাংলা সিনেমার জৌলুস পৌঁছয় না, সেখানেও 'শ্রীময়ী' পৌঁছে যায় এই মাধ্যমের ডিস্ট্রিবিউশনের দৌলতে। তবে 'শ্রীময়ী' যে দর্শকের কাছে এত জনপ্রিয় তার একটি বড় কারণ ইন্দ্রাণী হালদারের অসামান্য় অভিনয়।
এই চরিত্রটি তিনি যেভাবে তাঁর সম্পূর্ণ অভিনেত্রী সত্তার মধ্যে ধারণ করেন, তা অনবদ্য়। তার ভালবাসা, যত্ন, আত্মসম্মান, অভিমান-- প্রত্যেকটি আবেগ তীব্র অথচ কখনোই উচ্চকিত হয় না। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী প্রত্যেক দৃশ্যে তাঁর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যান। তবে ইন্দ্রাণী হালদারের আশেপাশে যদি চিত্রা সেনের মতো অভিজ্ঞ, সুদীপ মুখোপাধ্যায়-ঊষসী চক্রবর্তীর মতো দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা না থাকতেন, তাহলে ধারাবাহিকটি এই উচ্চতায় পৌঁছতে পারত না।
এই ধারাবাহিক বাংলা টেলিভিশনের সবচেয়ে স্মরণীয় ধারাবাহিকগুলির একটি হয়ে দর্শকের মননে থেকে যাবে। অনেকেই ব্যক্তিগত সম্পর্কে রাজনীতিকে বুঝবেন, আত্মসম্মানবোধ এবং দায়িত্ববোধের উপলব্ধি হবে।