৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারীদিবস। বেশ কিছু বছর ধরেই ভারতে এই দিনে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ছবি তৈরি হওয়াটা নয়া ট্রেন্ড। কিছু মিটিং-মিছিল, কিছু আলোচনা, কিছু অনুষ্ঠান, বাজারের নানা বিপণিতে কিছু চমকদার ছাড়ের ঘোষণা, সব মিলিয়ে ষোলোআনা। তাই সিনেমা রিলিজ হওয়াটাকেও বাঁকা চোখে দেখার কারণ নেই। বরং উদযাপনে এটাই বা থাকবে না কেন? এই আলোচনাতেই খুব সহজে চলে আসে বাংলা ছবিতে নারী চরিত্রদের কথা। তার থেকেই ধাপে ধাপে এগোতে থাকে নারীকেন্দ্রিক ছবি, নারীদের বাংলা ছবিতে বিবর্তন ইত্যাদি প্রভৃতি।
কারও মতে, নব্বইয়ের দশকের বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমা, যেখানে যৌথ পরিবার, বউমার সেবা ইত্যাদিই হতো প্রতিপাদ্য বিষয়, সেগুলিকেও নারীকেন্দ্রিক ছবি বলা হবে না কেন? নারীরা তো সেখানে মুখ্য চরিত্রেই ছিল। আবার অনেকেই এই প্রস্তাবে রাজি নন। তাঁদের মতে, এগুলি নারীকেন্দ্রিক ছবি বলা যায় না তার কারণ এখানে নারীরা বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী না দেবার স্পর্ধা দেখাতে পারেনি, নারীর ক্ষমতায়ন দেখানো হয়নি। তর্ক-বির্তক যখন বাংলা ছবিতে নারী চরিত্র-কেন্দ্রিক, তখন যে সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, তপন আসবেন তা স্বাভাবিক। ঠিক সেভাবেই পরবর্তী সময়ে আসবেন অপর্ণা, ঋতুপর্ণ। সেই নিরিখেই সাজানো হল সাত দশকের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু নারীকেন্দ্রিক বাংলা ছবি।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশক
সত্যজিৎ রায়-ঋত্বিক ঘটকের উত্থান এই দশকে আবার এই দশক অসিত সেনেরও। বিভিন্ন ধরনের ছবি তৈরি হয়েছে বাংলায়। তার মধ্যেই নারীকেন্দ্রিক ছবি সেভাবে আন্ডারলাইন না করা হলেও চিত্রনাট্যে মহিলা চরিত্ররা উজ্জ্বল ছিলেন অনেক ছবিতেই। বিতর্কের খাতিরে বলাই যায় এই চরিত্ররাও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। তবু ইন্দ্রাণী- (১৯৫৮) নীরেন লাহিড়ী, দীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৯)- অসিত সেন, দেবী (১৯৬০)- সত্যজিৎ রায়, মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)- ঋত্বিক ঘটক- মতো ছবি তৈরি হয়েছে পঞ্চাশের দশকেই।
'দীপ জ্বেলে যাই' ছবিতে নার্সের চরিত্রে দেখা যায় সুচিত্রা সেনকে। মনোরোগ সারিয়ে তোলার অভিনব নয়া পদ্ধতির সন্ধান শুরু হয়েছিল ওই সময়ে। নারীকে চিরকাল আশ্রয় ও শুশ্রুষার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু নারীর আশ্রয় কে? এই প্রশ্ন তোলে এই ছবি। বসন্ত চৌধুরী, পাহাড়ী সান্যাল, তুলসী চক্রবর্তীরা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে থাকলেও ছবির একজনই হিরো, তিনি সুচিত্রা সেন।
'দেবী' ছবিতে আবার নারীর ছদ্ম-ক্ষমতায়নকে কড়া সমালোচনা করেছেন সত্যজিৎ। দয়াময়ী ও উমাপ্রসাদের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বিয়ের পর, উমাপ্রসাদ কলকাতায় পড়তে চলে যায়। বৃদ্ধ শ্বশুরের দেখাশোনা করে দয়াময়ী। একদিন স্বপ্নে পুত্রবধূকে মা কালীর রূপে দেখে সে। কিন্তু দয়াময়ী তো দেবী নয়, মানবী হতে চেয়েছিল! নারীত্বে পুরুষতন্ত্র যখন দেবীত্ব আরোপ করে তখন তা কতটা ভয়াবহ, তা দেখিয়েছেন সত্যজিৎ।
ঋত্বিক ঘটকের চতুর্থ ছবি, 'মেঘে ঢাকা তারা'-তে আমরা দেখি দেশভাগের প্রেক্ষাপটে এক নারীর ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়ার গল্প। পঞ্চাশের দশকে কলকাতার এক রিফিউজি পরিবারের বড় মেয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয় পরিবারের জন্য অথচ তাঁর বাঁচার স্বপ্নই অপূর্ণ থেকে যায়।
আরও পড়ুন, Brahma janen gopon kommoti review: লোকাচার, শাস্ত্র নাকি সময় ‘সাম্যের’ পথে শবরী
সাহিত্য নির্ভর ছবির পথ চলা শুরু হয়ে গিয়েছিল ওই সময় থেকেই। শরৎচন্দ্র অথবা রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্রগুলি উঠে আসছিল বাংলা ছবিতে। ষাটের দশকে সাহিত্যনির্ভর নারীকেন্দ্রিক ছবিগুলির মধ্যে অবশ্যই সেরা ছবি চারুলতা (১৯৬৪)- সত্যজিৎ রায়। আবার স্বাধীনতার পরে মধ্যবিত্ত পরিবারের যে মেয়েরা একটু একটু করে পরিবারের বাইরে নিজেদের পরিচয় তৈরি করতে শুরু করছিলেন কর্মক্ষেত্র, তাঁদের কথা উঠে আসে মহানগর (১৯৬৩) ছবিতে।
সত্তর ও আশির দশক
এই সময়েই বলা চলে সত্যজিৎ, মৃণাল সেনের মতো পরিচালকেরা বাংলা ছবির দিগন্ত খুলে দেন। নারীর ক্ষমতায়নের ছাপ পড়েছিল সিনেমাতেও। তবে উত্তাল সত্তরে নারীকেন্দ্রিক ছবি কমই হয়েছে। রাজনৈতিক ছবিই বেশি হয়েছে সেই সময়ে। তার মধ্যেই উজ্জ্বল একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯)- মৃণাল সেন।
বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী মেয়ে চিনু এক রাতে বাড়ি ফেরে না। ওই একটি রাত বুঝিয়ে দেয়, মধ্যবিত্ত সমাজ ঠিক কী চোখে দেখে নারীকে। মেয়ের ফিরে আসার থেকেও মুখ্য হয়ে ওঠে সামাজিক লজ্জা। রক্ষণশীল বঙ্গ সমাজে নারীর নিগ্রহ, সামাজিক বদ্ধ ধারণার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করতে শুরু করে বাংলা ছবি। পরিচালক অপর্ণা সেনের আত্মপ্রকাশ এই সময়েই।
একের পর এক ছবিতে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের নারী চরিত্রগুলি উঠে এসেছে। নায়িকা চরিত্রগুলিকে যত্নশীলভাবে সাহসী করে তুলেছেন পরিচালক। একদিকে যেমন ৩৬ চৌরঙ্গী লেন (১৯৮১)-এ প্রান্তবাসী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান শিক্ষিকা উঠে এসেছে, তেমনই পরমা (১৯৮৫) ছবিতে অন্তঃসারশূন্য দাম্পত্যকে অস্বীকার করেছে নারী। নারী স্বাধীনতার কথা বলে পরমা। রাখি গুলজার অভিনীত এই ছবি জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত। বৌদি, বৌমা, কাকিমা-এই পরিচয়ের ঊর্দ্ধে উঠে এক মহিলা উত্তরণের গল্প। আবার সতী (১৯৮৯) ছবিতে সমাজের নিষ্ঠুর প্রথার সামনা সামনি আরও একবার দাঁড় করিয়েছেন অপর্ণা সেন।
আরও পড়ুন, Thappad movie review: তাপসী অভিনীত এই ছবি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি
এই দশকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবি হল গৌতম ঘোষের অন্তর্জলী যাত্রা (১৯৮৭)। এখানে সময়কাল ঊনিশ শতক কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা নব্যযুগের। বলা যায়, ফেলে আসা সময়ের নারীকে নব্য চেতনার আলোয় দেখা। নারী এখানে জ্বলে ওঠে আবার বিসর্জনও যায়।
নব্বই
এই দশক হল ঋতুপর্ণ ঘোষের। অপর্ণা সেনের পরে সবচেয়ে বেশি নারীকেন্দ্রিক ছবি রেখে গিয়েছেন তিনি। তবে তাঁর ছবির নারীরা হলেন পুরোপুরি শহুরে এবং বেশিরভাগই উচ্চ-মধ্যবিত্ত। উনিশে এপ্রিল (১৯৯৪) ও দহন (১৯৯৭) বাংলা ছবিতে একটি নতুন যুগের সূচনা করে। নব্বই এমন একটা দশক যখন মার্কিন দেশ থেকে সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ছিল থার্ড ওয়েভ ফেমিনিজম। চিন্তা-চেতনায় নারী স্বাধীনতা ও নারীর নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ যখন ঢুকে পড়ছিল, তখন সাহিত্যে ও সিনেমায় তার ছাপ তো থাকবেই।
এই দশকের শেষের দিকে বা মিলেনিয়াম বছরে তাই আমরা একযোগে তিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছবি দেখতে পাই। বাড়িওয়ালি (ঋতুপর্ণ ঘোষ) ও পারমিতার একদিন (অপর্ণা সেন) এবং উত্তরা (বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত)। দুটি ছবিতেই আমরা বনেদী বাড়ির পঞ্চাশের কোঠার দুই নারীকে দেখি। একজন চিরকুমারী আর অন্যজন মা। কিন্তু দুজনের মধ্যেই রয়েছে তীব্র একাকিত্ব ও না পাওয়ার জ্বালা। দুজনেই পরিবার নামক গণ্ডিতে আটকে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। প্রথম ছবিতে কিরণ খের ও দ্বিতীয় ছবিতে অপর্ণা সেন অনবদ্য সেই নারীদের চরিত্রচিত্রণে যাঁরা লালন করেন আর বাড়ি আগলে বসে থাকেন অপেক্ষায়।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র 'উত্তরা' মধ্যবিত্ত বাঙালি দর্শককে নিয়ে যায় সম্পূর্ণ অচেনা একটি জগতে। এই ছবিকে ঠিক নারীকেন্দ্রিক বলা যায় না তবুও এই ছবিতে দর্শক পেয়ে যান সেই নারীর রক্ত-ঘামের কথা, যাকে কখনও-সখনও চোখে পড়ে যায় প্রত্যন্ত গ্রামদর্শনে গিয়ে। এই দশকের শেষেই মুক্তি পেয়েছিল আর একটি উল্লেখযোগ্য নারীকেন্দ্রিক ছবি-- শতরূপা সান্যালের অনু (১৯৯৮)
আরও পড়ুন, কিছু অমানুষের জন্য রবীন্দ্রভারতীর বসন্ত উৎসব ঐতিহ্য হারাতে পারে না: নুর
২০০১ পরবর্তী
নতুন মিলেনিয়ামে ভারতীয় নারীর ক্ষমতায়ন প্রভাবিত করেছিল বাণিজ্যিক ছবিকেও। মিলেনিয়ামের প্রথম দশকে ঋতুপর্ণ ঘোষ একের পর এক নারীকেন্দ্রিক ছবি উপহার দিয়েছেন। এর মধ্যেই জ্বলে উঠেছিল একটি বাণিজ্যিক নারীকেন্দ্রিক বাংলা ছবি যা বক্স অফিসেও বিপুল সাড়া ফেলে-- তরুণ মজুমদারের আলো(২০০৩)।
তা বাদে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঋতুপর্ণ ঘোষের শুভ মহরৎ (২০০৩)। একটি রহস্য গল্পে ধরা পড়ে পাঁচ-ছটি নারী চরিত্রের ক্রাইসিস। প্রত্যেকেই তার নিজের নিজের সীমাবদ্ধতায় অসহায়। মিলেনিয়ামের প্রথম দশকে বেশ কয়েকটি নারীকেন্দ্রিক ছবি উপহার দিয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। নারীর যৌনতা ও যৌন তৃপ্তি নিয়ে যে শুচিবায়ুগ্রস্ততা রয়েছে বাঙালি সমাজে তাকে কিছুটা হলেও আঘাত করার চেষ্টা করেছে বার বার তাঁর ছবি। অন্তরমহল (২০০৫) তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তবে এই মিলেনিয়ামের প্রথম দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারীকেন্দ্রিক ছবি অবশ্যই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মন্দ মেয়ের উপাখ্যান (২০০২)
দ্বিতীয় মিলেনিয়ামে এসে নারীকেন্দ্রিক ছবির সংজ্ঞাটা অনেকটাই বদলেছে। তার একটা কারণ সম্ভবত এটাই যে সত্তর বা আশির দশকে নারী স্বাধীনতা কী এবং কেন, তার স্পষ্ট ধারণা ছিল না দর্শকের। কিন্তু দ্বিতীয় মিলেনিয়ামে এসে বাংলা ছবির দর্শকের একটা বড় অংশ হলেন সেই নারীরা যাঁরা নিজেদের উপার্জনের টাকাতেই টিকিট কেটে সিনেমা দেখতে যান।
এমনটা নয় যে সমাজে আর নারীর শোষণ নেই। ক্রাইসিসগুলো অনেকটাই পাল্টেছে। এই নতুন সময়ের ক্রাইসিস নিয়ে কিন্তু ভাল মানের বাংলা ছবি কমই তৈরি হচ্ছে। তাও এই দশকেই মুক্তি পেয়েছে অপর্ণা সেনের গয়নার বাক্স (২০১৩) অথবা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের বিসর্জন (২০১৭)। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের রাজকাহিনী (২০১৫)-তে একগুচ্ছ নারী চরিত্ররা আসে ঠিকই কিন্তু মানের দিক থেকে এই ছবিকে কখনোই পারমিতার একদিন বা মন্দ মেয়ের উপাখ্যান-এর সঙ্গে এক সারিতে রাখা যায় না।
আরও পড়ুন, ”মেঘ কেটে ঝকঝকে রোদ”, বোম্বাগড়ের গান গাইলেন কবীর সুমন, দেব ও অনিকেত
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়ের বেশ কয়েকটি ছবিতে নারী চরিত্ররা প্রাধান্য পেয়েছে ঠিকই কিন্তু এই পরিচালকদ্বয় মূলত সম্পর্কের গল্প বলেন সব ছবিতেই। নারীকে দেখা সম্পর্কের আলোতে। নারীকেন্দ্রিক বা প্রকারান্তরে সম্পর্ককেন্দ্রিক কিছু ছবি রয়েছে মৈনাক ভৌমিকের। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আমি ও আমার গার্লফ্রেন্ডস (২০১৩)। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে সদ্য পেরিয়ে আসা দশকে নারীকেন্দ্রিক ভাল মানের বাংলা ছবির অভাব রয়েছে।
সুজয় ঘোষের মতো বাঙালি পরিচালকেরা বলিউডে 'কাহানি'-র মতো ছবি তৈরি করেন আর বাংলা ছবি শুধুই ডুবে যেতে থাকে থ্রিলারে ও নিম্নমানের ট্রেজার হান্টে। তবু এখন নারীদিবস উপলক্ষে আলাদা করে ছবি মুক্তি পায় (সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত 'ব্রহ্মা জানেন') এ তো পরিবর্তনই বটে। কিন্তু মাইলস্টোন তৈরি করার মতো ছবির অভাব রয়েছে। নতুন দশকে তেমন কিছু আসবে বাংলা ছবিতে, এমনটাই আশা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন
সিনেমার ছবি সূত্র: সোশাল মিডিয়া