বাংলাভাষাকে তো সম্মান জানিয়েছেন বাংলাদেশ। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকেই ২১ ফেব্রুয়ারি আিন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এই আন্দোলন তো কলকাতা বা শিলিগুড়িতে হয়নি। হয়েছিল আজকের অধুনা বাংলাদেশে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান। আমার মনে হয় বাংলাভাষার কদর যথেষ্টই আছে। তবে বর্তমান প্রজন্ম যখন বলে, 'আমার না বাংলাটা ঠিক আসে না', সেটা ওদের দোষ বলে আমার মনে হয় না। এর জন্য অনেকাংশে দায়ী বাবা-মায়েরা। তাঁরা সন্তানদের বিদেশি কায়দায় মানুষ করতে চাইছেন। আমার বয়স এখন ৭৬। ১৯৪৯ সালে আমার জন্ম। আমরা ছোটবেলায় 'দেবসাহিত্য কুটির'-এর পুজো সংখ্যা পড়তাম। 'শিশুসাথী', সাময়িক কিছু পত্রিকা ছিল যা এখন সম্পূর্ণ বিলীন। কিন্তু, সেই দিকে কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। আমার সঙ্গে তো নবীনদের প্রতিনিয়ত কথা হয়।
ওঁরা কিন্তু, আমার সঙ্গে ইংরাজি বা ফরাসি ভাষায় নয়, বাংলাভাষাতেই কথা বলেন। ভাষা সচল একটা জিনিস। ভাষা তো কখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না। নড়াচড়া করে, ছোটাছুটি করে। তাই বাংলাভাষারও নানারকমের পরিবর্তন হচ্ছে, আগামী দিনেও হবে। নবীনরাই এই পরিবর্তনটা আনবে, আমার সেই ভরসা আছে। আমি কখনও হতাশ হই না বা ভরসা হারাই না। একফোটাও মনে হয় না যে আমাদের বাংলাভাষা কোথাও পিছিয়ে গিয়েছে। তবে যাঁরা বলছেন, 'আমার না বাংলাটা ঠিক আসে না', কারও সঙ্গে দেখা হলে নমস্কার না বলে ইংরাজিতে হাই-হ্যালো বলছে তাঁদের দেখেই তো ছোটরা শিখছে। আমার তো মনে হয় বড়দের ভূমিকাটা এখানে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আরও একটা বিষয় আমার মনে হয়, সবসময় উপদেশ বা জ্ঞান দিয়ে সবটা শেখানো যায়না। যদি রসে-বসে হয়, আগ্রহ তৈরি করা যায় তাহলেই হয়তো আর কেউ বলবে না, 'আমার না বাংলাটা ঠিক আসে না'।
আমি আর একজন একবার বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে কলকাতা থেকে লন্ডন যাচ্ছিলাম। ফ্লাইটটা শুরু হয়েছিল সিলেট থেকে। তখন দেখেছিলাম সেখানে ফ্লাইটে যাঁরা আমাদের আহ্বান করলেন তাঁরা প্রথমে সিলেটি ভাষায় কথা বললেন। তারপর বাংলা-ইংরাজি। ওটা আমার এত ভাল লেগেছিল। স্থানীয়ভাষাকে ওঁরা সম্মান করেন। এমনকী ফ্লাইট ছাড়ার আগেও স্থানীয় ভাষার ছোঁয়া রেখেই ঘোষণা করছিল। পুরুলিয়ার মানুষ যখন কলকাতায় এসে তাঁদের স্থানীয়ভাষায় কথা বলেন আমরা কিন্তু, বাঁকা নজরে দেখি। হাসাহাসি করি। কলকাতার দক্ষিণ দিকের ভাষাও খানিকটা অন্যরকম। ওঁরা কিন্তু আকাশকে 'রাকাশ' বলে। প্রত্যেকের মাতৃভাষা তাঁদের কাছে সম্মানের। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মানে কিন্তু শুধু বাংলা ভাষা নয়, প্রত্যেকটি সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা উদযাপনের দিন।
কলমে কবীর সুমন