জানেন কি, যে এবছরের নভেম্বর মাসে মুক্তি পায় রেকর্ড সংখ্যক বাংলা ছবি? দুঃখের বিষয়, যথাযথ প্রচার এবং বাণিজ্যিক পরিকল্পনার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে বেশিরভাগই, যদিও সমালোচকদের প্রশংসা পায় বেশ কয়েকটি ছবি।
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য নন্দনে অন্য ছবি দেখানো সম্ভব ছিল না, অতএব একাধিক প্রযোজক অপেক্ষা করেছিলেন উৎসব শেষ হওয়ার। অপর্ণা সেনের মতো অনেকে উৎসবের শেষ দিন, অর্থাৎ ১৫ নভেম্বর, ছবি রিলিজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর ছবি 'ঘরে বাইরে আজ' রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস 'ঘরে বাইরে' সম্পর্কে অপর্ণার ব্যক্তিগত উপলব্ধির ভিত্তিতে সমকালীন প্রেক্ষিতে তৈরি। এই ছবিই সত্যজিৎ রায় করেন ১৯৮৪ সালে।
পরিচালক হিসেবে 'ঘরে বাইরে আজ' অপর্ণা সেনের উত্তরণের ইঙ্গিত দেয়। এই উত্তরণ উল্টোমুখে বইতে শুরু করে 'ইতি মৃণালিনী'-র পর, মোটামুটি সমতলে পৌঁছয় 'গয়নার বাক্স' দিয়ে, এবং আবার নামতে শুরু কর 'আরশিনগর' এবং 'সোনাটা'-র পর। 'ঘরে বাইরে আজ' একটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক ছবি, কিন্তু খুঁটিনাটির প্রতি নজর, চরিত্রায়ন, এবং ঘরে ও বাইরের পারস্পরিক সম্পর্কের অভিঘাতে অপর্ণার পরিচিত স্বাক্ষর সুস্পষ্ট।
আরও পড়ুন, সৃজিতের ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর লুক, বাজিমাত অনির্বাণের
পরিচালক নিজে বলেছেন, "গৌরী লঙ্কেশের নির্মম, নিষ্ঠুর হত্যা ট্রিগারের কাজ করেছিল। যে প্রশ্নটা আমার মনে এল তা হলো - ১০০ বছর আগে 'ঘরে বাইরে' লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার পর থেকে কিছুই বদলায় নি। আমাদের ট্র্যাজেডি হলো যে, আমরা একটি তথাকথিত স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম দেশের নাগরিক। অথচ দক্ষিণপন্থী হিন্দুদের মনে নিরপেক্ষ ভারতবর্ষে বিশ্বাসী মানুষদের প্রতি এত বিদ্বেষ কেন?
ভিন্ন যৌনতার উৎসব 'ডায়ালগস'
শীতের শুরুতেই কলকাতায় বাজতে থাকে নানারকমের চলচ্চিত্র উৎসবের ঘণ্টা। নানা রঙের উৎসব, বিনোদনের নানা ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান, যা থেকে সমৃদ্ধ হয় সিনেমাপ্রেমীদের অভিজ্ঞতার ঝুলি।
পঁচিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হতে না হতেই শহরে প্রবেশ করল 'Dialogues', ভারতের সবচেয়ে পুরোনো অবাণিজ্যিক ভিন্ন যৌনতার চলচ্চিত্র উৎসবের ১৩ তম অধ্যায়। চারদিনের এই উৎসব শুরু হয় ১৯ নভেম্বর, শেষ হয় ১ ডিসেম্বর, যৌথ পরিচালনায় ছিল স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি, প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট, গ্যেটে ইন্সটিটুট/ম্যাক্স মুলার ভবন, দ্য বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, বসুশ্রী সিনেমা, ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং ফ্লেয়ার ফিল্ম প্যাকেজ। চারদিন ধরেই মোটামুটি দর্শকের ভিড় দেখা গেল।
আরও পড়ুন, Mardaani 2 movie review: বলা বাহুল্য শিবানীই শেষ কথা
এই উৎসবের অভিনবত্ব এই যে এটি ভিন্ন যৌনতাকে সম্মান জানায়। রূপান্তরকামী, গে, লেসবিয়ান, এবং এমন অনেক মানুষ যাঁদের মূলস্রোত-বহির্ভূত ধরে নেওয়া হয়, কিন্তু যাঁরা আদপেই তা নন।
বিশেষ করে চোখে পড়ার মতো ছিল বসুশ্রী সিনেমার আমূল পরিবর্তন। ঐতিহাসিক এই প্রেক্ষাগৃহ, যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালে, আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সিঙ্গল-স্ক্রিন যুগের প্রতিনিধি হিসেবে। বসুশ্রীর ভেতরে এবং আশেপাশে ওই চারদিন ছিল রঙবেরঙের পোশাকে তরুণ-তরুণীদের ভিড়, বই এবং ম্যাগাজিন বিক্রিতে ব্যস্ত, এমনকি বসুশ্রীর লবিতে বসেছিল ড্রয়িং এবং নানারকমের ছোটখাটো গয়নার পসরা।
এবছরের উৎসবে দেখানো হয় ন'টি সাম্প্রতিক স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি, যা ইতিমধ্যেই প্রদর্শিত হয়েছে বিএফআই ফ্লেয়ার (BFI Flare)-এ, যা হলো লন্ডনের ভিন্ন যৌনতার চলচ্চিত্র উৎসব।
আরও পড়ুন, ‘আমার আসাম জ্বলছে, কাঁদছে’, দিল্লির শো বাতিল পাপনের
যে চারটি ছবি দেখলাম, আলাদা করে অবশ্যই বলা উচিত তথাগত ঘোষের 'মিস ম্যান'-এর কথা। বাকি তিনটি ছবি হলো যুগ্ম পরিচালক সৌভিক এবং সাত্যকি চক্রবর্তীর 'আদিপাক্রিতি', দেবাদৃতা বোসের 'গুডবাই বিউটিফুল', এবং প্রিয়া সেনের 'ফ্রিডম লাইফ', কিন্তু এগুলি নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই, কারণ বিষয়বস্তুর মাধ্যমে যা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কাজে তা করে দেখানো যায় নি।
প্রভূত হাততালি পেয়েছে তথাগত ঘোষের 'মিস ম্যান'। তাঁর নিজের কথায়, "ছবিটা একান্ত ব্যক্তিগত, এমন কিছু ঘটনার ভিত্তিতে তৈরি যেগুলো আমার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। নিজেদের ভিন্ন যৌনতার কথা প্রকাশ্যে আনতে দীর্ঘদিন লড়াই করেছে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব। ওদের যন্ত্রণাটা আমি দেখেছি। ওদের যৌনতার কারণে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হয়েছে। গত বছর ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা, যার আওতায় "প্রকৃতি-বিরোধী" যৌনক্রিয়াকে অবৈধ মানা হতো, তা সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিলেও মানুষ এখনও খোলা মনে মেনে নিতে পারে নি। এখনও সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে নিজেদের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হয় অনেককে। আমার এক বন্ধুর এরকমই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি এই ছবিটি তৈরি করি। আমার ভেতরের যন্ত্রণা, হতাশার থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল এই ছবি।"
'রবিবার' এর প্রথম ঝলক
সম্প্রতি মুক্তি পেল জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক অতনু ঘোষের ছবি 'রবিবার'-এর ট্রেলার। মুক্তির দিন অতনু বলেন, "আমার চরিত্রদের ঘোরালো পরিস্থিতির মাঝখানে ফেলে দিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখি আমি। আমার বেশিরভাগ ছবিতেই প্রধান চরিত্ররা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জীবনভরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নেয়, যেহেতু তারা নানা আবেগের মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়, যেমন নারী-পুরুষের সম্পর্ক, স্নেহ, মোহ, লালসা, বন্ধুত্ব, ভালবাসা, এমন আরও অনেক কিছু। এই করতে গিয়ে তাদের জীবনের উপলব্ধি আমূল পাল্টে যায়। আমার এই ট্রিলজি - 'ময়ূরাক্ষী', 'বিনি সুতোয়', এবং 'রবিবার'-এর মধ্যে দিয়ে আমার চরিত্ররা নিজেদের খুঁজে পায়। পরিচালক হিসেবে আমিও নিজেকে খুঁজে পাই।"
এই ছবির অভিনবত্ব হলো প্রসেনজিৎ এবং জয়া আহসানের জুটি, যাঁরা এই মুহূর্তে বাংলা ছবির সবচেয়ে গ্ল্যামারাস এবং সুশিক্ষিত অভিনেতা। ট্রেলার দেখে আগ্রহ জাগে নিঃসন্দেহে, এবং অতনুর ছবির ট্রেডমার্ক সূক্ষ্ম থ্রিলার আঙ্গিকের আভাসও পাওয়া যায়। দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গীতও প্রাপ্তির আশা জাগায়। দেখা যাক।