ছবি- উমা
অভিনয়- সারা সেনগুপ্ত, যীশু সেনগুপ্ত, অঞ্জন দত্ত, শ্রাবন্তী, সায়ন্তিকা
পরিচালনা- সৃজিত মুখোপাধ্যায়
রেটিং- ৪/৫
সৌরদীপ সামন্ত
প্যাচপ্যাচে গরম, কালবৈশাখী, ইয়ার-এন্ডিং...এমন দুঃসময়ে কলকাতা সেজেছে অকালবোধনে। না, এ রামচন্দ্রের অকালবোধন নয়। এ আরেক ‘উমা’র অকালবোধন। আর তার জন্যই শহর জুড়ে যেন দুর্গাপুজোর মরশুম। চারিদিকে সাজ সাজ রব। বড় বড় প্যান্ডেল, দশহাতে অস্ত্র নিয়ে অসুর বধের ঢঙে দাঁড়িয়ে মা দুগ্গা। ঠাকুর দেখতে রাস্তায় শুধুই মানুষের চেনা ভিড়। সেই যেন শরতের চেনা কলকাতার আমেজ। মার্চ-এপ্রিল মাসে ঢাকের আওয়াজ, কাশফুল, দুর্গাপুজো...বেমানান নয় কি? না, একেবারেই নয়। ইচ্ছে থাকলে, ইচ্ছেপূরণের ভালবাসা থাকলে, মার্চ-এপ্রিল, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, শুধুমাত্র ক্যালেন্ডারের মাস বলেই মনে হবে। আবেগ, ভালবাসার কাছে গ্রীষ্ম আর শরতের ফারাক বোধহয় অদৃশ্য হয়ে যায়। পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘উমা’ যেন সেরকমই এক আবেগকে উস্কে দিল।
ছোট্ট মেয়ে মাম্পিকে(সারা) নিয়ে সুদূর সুইজারল্যান্ডে থাকেন হিমাদ্রি সেন (যীশু)। মেয়ের কঠিন অসুখ, আর বড়জোড় তিনমাস, তারপর মাম্পির চোখ চিরতরে বুজে যাবে। এমনই রিপোর্ট দিয়েছেন চিকিৎসক। ছোটোবেলা থেকে বাবার মুখে কলকাতার দুর্গাপুজোর গল্প শুনেছে সে। মাম্পি বায়না করেছে, সে কলকাতার দুর্গাপুজো দেখবে...প্যান্ডেল-হপিং করবে। এদিকে দুর্গাপুজো অক্টোবরে। ডাক্তারের কথামতো, ততদিনে তো মাম্পি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবে। তাহলে উপায়? একমাত্র আদরের মেয়ের যেন শেষ ইচ্ছেপূরণের দায়িত্ব নিয়েই নিলেন বাবা। সুইজারল্যান্ড থেকে কলকাতায় এলেন হিমাদ্রি। মেয়ের শেষ আবদার রাখতে শুরু হল এক অকালবোধনের তোড়জোড়। তারপর? কীভাবে কাঠখড় পুড়িয়ে মার্চ-এপ্রিলেই কলকাতায় আস্ত দুর্গাপুজোর আয়োজন করলেন হিমাদ্রিরা, তা নিয়েই তৈরি হয়েছে উমা ছবির কাঠামো।
আরও পড়ুন, সিনেমা রিভিউ: রেনবো জেলিতে রূপকথার স্বাদ ফিকে!
২০১৫ সাল, অক্টোবর মাসেই বড়দিন পালন করেছিল কানাডার ছোট্ট শহর সেন্ট জর্জ। উপলক্ষ ছিল, সাত বছরের ইভান লিভারসেজের ইচ্ছেপূরণ। ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, ইভানের সময় শেষ। বড়দিন ভালবাসতেন, তাই পরিজনরা, ইভানের চোখে-মুখে খুশি দেখার জন্য বড়দিনের আগেই বড়দিনের আয়োজন করেছিলেন। বাস্তবের ইভান, আর সিনেমার উমা। না, দুই চরিত্র কখনই বাস্তব ও কাল্পনিকের দ্বন্দ্বে জড়াবে না। রিয়েল লাইফের ইভানের অনুপ্রেরণায় তৈরি রিল লাইফের উমা, আবেগ, ভালবাসা, ইচ্ছেপূরণের গল্প বলবে। আবেগের কাছে সম্পর্কের দূরত্ব কতটা কমে যেতে পারে, অচেনা সম্পর্ক কতটা কাছের হয়ে যেতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ এ ছবি। আবেগের কাছে মানুষের মান-অভিমান হার মানে বলেই তো, বহু বছর বাদে সম্পর্কের বেড়াজাল ভেঙে মুখোমুখি হয় ব্রহ্মানন্দ (অঞ্জন দত্ত) ও তাঁর স্ত্রী মেধা (গার্গী), হিমাদ্রি ও তাঁর স্ত্রী মেনকা (সায়ন্তিকা)। আবেগের টানেই তো বিজয়া দশমীর দিন বাবুঘাটে মাম্পির জন্য ভিড় করেন চাকুরিজীবী থেকে ফেরিওয়ালা। আবেগের বশেই তো, মহীতোষ সুরের (অনির্বাণ) চোখেও জল টলমল করে ছোট্ট মাম্পির জন্য।
আরও পড়ুন, সিনেমা রিভিউ: থ্রিলারে মোড়া মানবিকতার গল্পই গুডনাইট সিটি
এ ছবিতে অভিনয়ে একে অন্যকে টেক্কা দিয়েছেন। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন একজনই। তিনি অঞ্জন দত্ত। সেরার সেরা অভিনেতার তকমাটা তাঁরই প্রাপ্য। হিমাদ্রির চরিত্রে যীশু সেনগুপ্ত বেশ ভাল। অনির্বাণ ভট্টাচার্যও হাততালি, সিটি কুড়োবেন। শ্রাবন্তীর অভিব্যক্তি, চোখের জলও নজর কাড়বে। এছাড়াও, রুদ্রনীল ঘোষের হালকা টোনের কমেডি আলাদা মাত্রা আনে ছবিতে। গার্গী রায়চৌধুরীর ছোট্ট উপস্থিতিও তারিফ করার মতো। সায়ন্তিকার বিশেষ কিছু করার ছিল না। তবে পুজোর সময় গাড়িতে বসে দূর থেকে মেয়েকে দেখার সময় তাঁর এক্সপ্রেশন মন্দ নয়। একটি বিশেষ চরিত্রে বাবুল সুপ্রিয়ও আলাদা করে ছাপ ফেলেছেন। এবার আসা যাক, তার কথায়। হ্যাঁ, প্রথম ছবিতে ভাল ফিডব্যাকই পাবে সারা সেনগুপ্ত। সারার স্ক্রিন প্রেজেন্স বেশ ভাল, খুবই মিষ্টি লেগেছে যীশু কন্যাকে।
সিনেম্যাটোগ্রাফি থেকে সংলাপ, বেশ ভাল। অনুপম রায়ের সুরে গানগুলো ছবিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে মন ছুঁয়ে যায় ‘হারিয়ে যাওয়ার গান’। ছবিতে কিছু চমক রয়েছে, যা মন কাড়বে দর্শকদের। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ছবি শেষ করেছেন পরিচালক।
src="https://www.youtube.com/embed/6RcZKX_Y5Ws" width="100%" height="415" frameborder="0" allowfullscreen="allowfullscreen">
তবে খটকাও আছে। কলকাতার দুর্গাপুজোর যা ক্রেজ, তাতে করে অসময়ে এমন নকল পুজোর আয়োজন আদৌ কি বাস্তবসম্মত? হ্যাঁ, সেন্ট জর্জ শহরে অক্টোবর মাসেই বড়দিনের আয়োজন করা হয়েছিল সেকথা ঠিক। কিন্তু কলকাতার জনসংখ্যা আর দুর্গাপুজোর ব্যাপ্তির সঙ্গে সেন্ট জর্জের বড়দিনের উৎসব কি এক হতে পারে? খটকার এখানেই শেষ নয়। মাম্পি একডালিয়া, দেশপ্রিয় পার্কের পুজো দেখবে বলে রাতারাতি বাকিংহাম প্যালেসের আদলে মণ্ডপ তৈরি করা হল। এমন মণ্ডপ গড়তে যে প্রস্তুতি ও সময় লাগে, সেদিক থেকে রাতারাতি এমনটা করা কার্যত অসম্ভব। এই ছোটোখাটো খুঁত দেখেও না দেখার ভান করলে, কিছু যায় আসবে না। হল থেকে বেরোনোর পর দর্শকমনে উমার বিসর্জন ঘটবে না, আর এখানেই জিতে গিয়েছেন উমার কারিগররা।