Santosh Dutta: ১৯৫৮ সালে সত্যজিৎ রায়ের 'পরশপাথর' ছবি দিয়েই বাংলা সিনেমায় তাঁর পথচলা শুরু। যাঁরা দেখেছেন ছবিটি তাঁরা নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ঘোষককে। তখনও বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কাছে অজানা ছিল যে এক অসামান্য অভিনেতার যাত্রা শুরু হল। বাংলায় প্রায় পঞ্চাশটি ছবিতে অভিনয় করেন সন্তোষ দত্ত। কিন্তু বাংলা ছবির বেশিরভাগ দর্শক তাঁকে মনে রেখেছেন ফেলুদা সিরিজের 'জটায়ু' হিসেবে। তা বাদে সন্তোষ দত্ত অভিনীত আরও বহু চরিত্র রয়েছে যা বাংলা সিনেমায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২ ডিসেম্বর, তাঁর জন্মদিনে আরও একবার স্মরণ করা যাক সেই চরিত্রগুলির কথা--
গবেষক ( হীরক রাজার দেশে, ১৯৮০)
সন্তোষ দত্ত অভিনীত সেরা চরিত্রগুলির তালিকায় সবচেয়ে উপরে রাখতেই হবে এই চরিত্রটিকে-- সমাজবিমুখ, রাজনৈতিক সচেতনতা-বর্জিত এক বিজ্ঞানী, যে তার আবিষ্কারের সম্ভাব্য প্রয়োগ নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। চরিত্রটিকে প্রথম থেকে দর্শক ভেবে বসবেন আপাত-নিরীহ, কিঞ্চিৎ লোভী এক জ্ঞানের উপাসক। কিন্তু ছবির শেষের দিকে যখন সে উগ্র হয়ে উঠে বলে-- 'আমি কারও দলে নই, আমি বিজ্ঞানী'-- তখন পরিচালক ঠিক যে বার্তা দিতে চান দর্শককে, তা অসম্ভব দক্ষতায় চোখে আঙুল দিয়ে দর্শককে দেখান অভিনেতা।
আরও পড়ুন: হোটেল মুম্বই রিভিউ: একটি রোমহর্ষক ছবি
শুন্ডিরাজা ও হাল্লারাজা (গুপী গাইন বাঘা বাইন, ১৯৬৮)
এই দুটি চরিত্রই সমান গুরুত্বপূর্ণ। পরস্পরবিরোধী এই দুটি চরিত্রেই সন্তোষ দত্তের অসামান্য অভিনয় যদি না থাকত, তবে এই ছবির প্রয়োগ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। বিশেষ করে হাল্লারাজার চরিত্রটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 'হাল্লা চলেছে যুদ্ধে' গানের দৃশ্যটির শেষে যখন গুপী তার গান ধরে, যখন একটু একটু করে হাল্লারাজার উপর বরফির জাদুর প্রভাব কমতে থাকে, চরিত্রের ওই ট্রানজিশনটি অনবদ্য। অভিনয় শিক্ষার্থীদের পাঠ্য হওয়া উচিত ওই দৃশ্যটি। আবার শুন্ডিরাজার চরিত্রটি এমনই শুভ্র, তা কমিক হলেও এত রাজকীয়, অভিনয়ের এই ভারসাম্যই অত্যন্ত কঠিন যা তিনি অত্যন্ত সহজাত ভাবে করতেন।
অবলাকান্ত (ওগো বধূ সুন্দরী, ১৯৮১)
সন্তোষ দত্তের অন্যতম সেরা অভিনয় এই চরিত্রটি। নিতান্তই বাণিজ্যিক সিনেমা এবং ছবির বিষয়বস্তুও অগভীর কিন্তু অভিনেতা তাঁর কাজটুকু করেছেন অপরিসীম দক্ষতায়। পপুলার কালচারে এই চরিত্রটি একটি লেজেন্ড যা নিয়ে চার দশক পরেও দর্শক নিয়মিত আলোচনা করেন।
আলিবাবা (মর্জিনা-আবদাল্লা, ১৯৭৩)
এই চরিত্রটি নামমাহাত্ম্যেই গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক প্রজন্ম রূপকথার বইতে যে চরিত্রের কথা পড়ে বড় হয়েছে, সেই ফ্যান্টাসি চরিত্রে রূপদান নিঃসন্দেহে অভিনেতার জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি। ছবিটি যেমনই হোক না কেন, আলিবাবা চরিত্রে সন্তোষ দত্তের অভিনয় চিরস্মরণীয়।
আরও পড়ুন: Ghawre Bairey Aaj movie review: সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী ছবি
কিশোরী চাটুজ্যে (সমাপ্তি, ১৯৬১)
ষাটের দশকের বাংলায়, প্রত্যন্ত এক গ্রামের কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার এই চরিত্রটি খুব বেশি কিছু কথা না বলেই অনেক কিছু বলে। কলকাতায় পড়া শিক্ষিত ছেলের মেয়ে দেখতে আসায় বর্তে যাওয়া থেকে শুরু করে সম্ভাব্য পাত্রের আচমকা কাশির দমক সামাল দেওয়া-- সমাপ্তি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা এই চরিত্রটিকে কোনওদিন বিস্মৃত হবেন না।
গোপাল ভাঁড় (১৯৮০)
এই কিংবদন্তি চরিত্রটিতে ওই সময় সন্তোষ দত্ত ছাড়া আর কোনও অভিনেতাকে কল্পনা করা সম্ভব ছিল না। আসলে কমেডি চরিত্রে অভিনয় তাঁর কাছে এতটাই সহজাত ছিল যে কোনও লার্জার দ্যান লাইফ কমেডি চরিত্রে কাস্টিং করতে বসলে তাঁর কথাই সবার আগে মনে পড়ত। তাই আশির দশকে তাঁকে ছাড়া নির্মাতারা যেমন গোপাল ভাঁড়-কে ভাবতে পারেননি, দর্শকও পারতেন না।
তবে এই চরিত্রগুলি ছাড়াও আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে যেগুলির উল্লেখ প্রয়োজন। যেমন, 'জনঅরণ্য' (১৯৭৬) ছবির হীরালাল সাহা অথবা তাঁর প্রথম ছবি 'পরশপাথর' (১৯৫৮)-এর অতনু, 'মহাপুরুষ' (১৯৬৫)-এর প্রফেসর নন্দী অথবা 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' (১৯৭৩)-এর নবীন মাস্টার। পেশায় আইনজীবী এই অভিনেতা সারাজীবন তাঁর নেশাটিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। অভিনয় ও সিনেমার প্রতি অদম্য প্যাশন ছাড়া যা অসম্ভব।