সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁর পছন্দের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছি আমরা। আজ এই সিরিজের প্রথম কিস্তিতে রইল তাঁর প্রিয় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের শ্রেষ্ঠাংশ। তিনি কথা বলেছেন আমাদের প্রতিনিধি অলকা সাহনির সঙ্গে।
আপনি কী করে অভিনেতা হয়ে উঠলেন! সত্যজিৎ রায় কি অপুর সংসার (১৯৫৯) ছাড়া অন্য কোনও ছবির জন্য ভেবেছিলেন?
আমি ছেলেবেলায় যখন হাওড়া জেলা স্কুলে পড়ি তখন থেকে, আর তার পর কলকাতায় সিটি কলেজে পড়বার সময় থেকে অভিনয়ে উৎসাহী ছিলাম।
১৯৫৫ সালে যখন পথের পাঁচালী মুক্তি পেল, তখন আমি কলেজে পড়ি। মাণিকদা তখন অপরাজিতর লিড রোলে অভিনয় করতে পারে এমন কাউকে খুঁজছিলেন। আমার এক বন্ধু যে ওঁর কাজে সাহায্য করত, সে আমায় পরিচয় করিয়ে দেয়।
ওই চরিত্রের জন্য আমার বয়স বেশি ও আমি বেশি লম্বা বলে মনে হয়েছিল ওঁর। অপরাজিত ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা ছবির পুরস্কার (গোল্ডেন লায়ন) পায়। এক সাংবাদিক সম্মেলনে মাণিকদা ঘোষণা করেন, তিনি এই ছবির তৃতীয় ভাগ বানাবেন। কলকাতায় ফেরার পর তিনি বলেছিলেন, প্রাপ্তবয়স্ক অপুর চরিত্র কে করতে পারে, সে কথা ওঁর মাথায় রয়েছে। আমার কোনও ধারণাই ছিল না উনি আমার কথা ভাবছেন। অপুর সংসারের কয়েক বছর পর, আমাকে জানানো হয়, আমাদের প্রথমবার দেখা হওয়ার পরেই উনি ট্রিলজির কথা ভেবে রেখেছিলেন।
অপুর সংসার আপনার প্রথম ছবি ছিল। এর পর আপনার জীবন কীভাবে বদলে গেল?
এই ছবি আমার কেরিয়ার তৈরি করে দিয়েছিল এবং পেশাদার অভিনেতা হিসেবে আমার জীবন শুরু করার সুযোগ করে দিয়েছিল। ততদিন পর্যন্ত আমি মঞ্চে ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করতাম। অপুর পর, অবশেষে আমি যা চাইছিলাম তাই পেলাম।
আপনি বলেছেন, আপনি যখন ক্যামেরার মুখোমুখি হতেন, তখন সত্যজিৎ রায় আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করতেন না। এটা কি শুরু থেকেই এরকম ছিল?
প্রায় শুরু থেকেই। অপুর সংসারের শুটিং শুরু হওয়ার আগে, উনি আমাকে অনেকদূর পর্যন্ত তৈরি করে নিয়েছিলেন। আমাকে ছবির মূল বিষয় ও চরিত্র সম্পর্কে ওঁর ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন। তখন, রবিবার সকালে সিনেমা হলগুলোতে ভাল হলিউডের ছবি দেখানো হতো। আমি ওঁর সঙ্গে সিনেমা হলে যেতাম। কখনও কখনও কোনও কোনও চরিত্রের অভিনয়ের বিশেষ দিকগুলি উনি আমাকে লক্ষ্য করতে বলতেন। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি উৎসাহের ব্যাপার ছিল পথের পাঁচালী। সে ছবি দেখতে দেখতে আমার মনে হতো, আমাদের অভিনয় কেমন হওয়া উচিত।
আপনি অনেক বড় বড় পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন, যাঁদের মধ্যে তপন সিনহা ও মৃণাল সেনও রয়েছেন।
শুরু থেকেই আমি কাঙ্ক্ষিত অভিনেতা ছিলাম। অপুর সংসারের পর, আমি তপন সিনহার ক্ষুধিত পাষাণে (১৯৬০) অভিনয় করি, তারপর অসিত সেন (স্বয়ম্বর, ১৯৬১) এবং মৃণাল সেন (পুনশ্চ, ১৯৬১)-এর সঙ্গে।
আপনার ২০১৫ সালে প্রকাশিত বই The Master and I-তে আপনি উল্লেখ করেছেন, পরের দিকে সত্যজিৎ কীভাবে আপনার সম্পর্কে পজেসিভ হয়ে উঠেছিলেন।
তপন সিনহা যখন তাঁর ছবিতে আমাকে কাজ করতে বলেন, তখন আমি মাণিকদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কাজটা করব কিনা। মানিকদা বলেছিলেন, অবশ্যই করা উচিত, এবং এমন সুযোগ হাত থেকে যেতে দেওয়া উচিতই নয়।
মাণিকদা আমার সম্পর্কে অন্যভাবে পজেসিভ ছিলেন, যেমনভাবে বাবা ছেলের সম্পর্কে পজেসিভ হন, তেমন।
আরও পড়ুন: ‘সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে একটা শিশুর সারল্য ছিল’
সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির মূল চরিত্রে অন্য পুরুষ অভিনেতাদের কাস্ট করলে আপনার কেমন লাগত?
সে যদি বলেন, যতবার মাণিকদা ছবি বানাতেন, আমি তাতে কাজ করতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু সেটা তো সম্ভব ছিল না। আমি অনেক ছবিতে কাজ করতাম। উনি আমার মেন্টর হয়ে উঠেছিলেন। আমি ওঁর কাছ থেকেই চলচ্চিত্র সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। সাহিত্যের খুব জিজ্ঞাসু ছাত্র ছিলাম। ওঁর কাছ থেকে সিনেমা, অভিনয় সহ বিভিন্ন বিষয়ের বই ধার করে আনতাম। এটা একটা জটিল কিন্তু উপভোগ্য সম্পর্ক ছিল।
অপু থেকে ফেলুদা, সত্যজিতের বিভিন্ন ছবিতে আপনি বিভিন্ন রকমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ফেলুদা সাহিত্যের এত জনপ্রিয় চরিত্র। আপনার কি কোথাও দায়িত্বের কথা মনে হতো?
সত্যি বলতে কী, না। আমি যখনই কোনও ছবিতে অভিনয় করেছি, তখনই চরিত্রের আরও গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। মাণিকদা আমাকে এত রকম চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছেন, তার মধ্যে সমাপ্তিতে অমূল্য (তিন কন্যা, ১৯৬১), অভিযানে নরসিং (১৯৬২), অশনি সংকেতে গঙ্গাচরণ (১৯৭৩), যে চরিত্রের সঙ্গে আমি খুব ভালভাবে রিলেট করতে পারি কারণ আমি নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের মত ছোট শহর থেকে এসেছি এবং ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ দেখেছি।
তবে ফেলুদা করার সময়ে একটা বিষয়ে আমি খুশি হয়েছিলাম যে অবশেষে আমি একটা চরিত্রে অভিনয় করতে পারছি, যেটা দেখে আমার ছেলেমেয়েরা আনন্দ পাবে। কিন্তু ফেলুদা যখন কাল্ট হয়ে উঠল, সে সময়ে আমার খুব আশ্চর্য লাগত যে কেন লোকে, বিশেষ করে ছোটরা, শুধু ফেলুদা করার জন্য আমাকে মনে রাখছে। পরে আমি বুঝেছিলাম, যে আমার ভুল হয়েছিল। একজন ছোট বাচ্চাও যদি আমাকে ফেলুদা হিসেবে মনে রাখে, তাহলে তা অভিনেতা হিসেবে আমাকে আনন্দেই দেবে।
সত্যজিতের ছবি থেকে আপনার প্রিয় চরিত্র বেছে নিতে পারবেন?
এইটা খুব কঠিন। আমি সত্যজিতের ১৪টা ফিচার ফিল্ম আর দুটো শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছি। আমি ওঁর শেষ ছবি উত্তরণ (১৯৯৪)-এ কাজ করেছি, যেটা ওঁরই লেখা। আমাদের ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুটিং শুরু করার কথা ছিল, কিন্তু তার এক মাস আগেই উনি হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৩ এপ্রিল, ১৯৯২-এ ওঁর মৃত্যুর পর ওঁর ছেলে ছবিটা শেষ করে। মাণিকদার এত ছবিতে এত বছর ধরে কাজ করার পর আমার মনে হয়েছিল, এটা বড় ছবি।
কোনও খেদ রয়েছে?
সত্যজিতের যেসব ছবিতে আমি কাজ করতে পারিনি, সে নিয়ে আমার কষ্ট আছে। যেমন মাণিকদাকে আমি গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৯) ছবিতে আমাকে নিতে বলেছিলাম। মাণিকদা বলেছিলেন, ওই চরিত্রের যে ছবি তিনি ভেবে রেখেছেন, তার সঙ্গে আমার চেহারা খাপ খায় না।
আমি যখন ছবিটা দেখি, তখন তপেন চট্টোপাধ্যায়ের গুপী চরিত্রে অসামান্য অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘায় (১৯৬২) অশোকের চরিত্রে অভিনয়ের ব্যাপারে প্রায় সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার ডেটের সঙ্গে মেলেনি। ঘটনাক্রমে অরুণ মুখোপাধ্যায় সে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এবং দারুন কাজ করেছিলেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন