সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁর পছন্দের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছি আমরা। এযাবৎ এই সিরিজে প্রকাশিত হয়েছে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মমতা শঙ্কর, বরুণ চন্দ, এবং মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকার। এই সিরিজে নিজেই কলম ধরেছেন কিংবদন্তী অস্কারজয়ী মার্কিন পরিচালক মার্টিন স্করসেসে। আজ শেষ কিস্তিতে ফের একবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর জন্য কলম ধরলেন শর্মিলা ঠাকুর:
"জানি না কেন, মাণিকদার শততম জন্মবর্ষে আমার মনটা ফিরে যায় তাঁর মৃত্যুদিনে। হয়তো লকডাউনের প্রভাব। পতৌদিতে আমাদের বাড়িতে আমি খবরটা পাই। তার আগে থেকেই অবশ্য নিয়মিত জানতে পারছিলাম তাঁর শারীরিক অবনতির কথা, তবু তাঁর চলে যাওয়াটা যেন অকস্মাৎ আঘাত করল। বাকি দিনটা কী হয়েছিল মনে নেই। পরে, যখন আমি ঘরে একা, তখন অবশেষে যেন মাথায় ঢুকল যে আর তাঁকে দেখতে পাব না। তাঁর বাড়িতে গেলে আর মাণিকদা দরজা খুলে বলবেন না, "এসো রিঙ্কু। বম্বের খবর বলো!" জানলার পাশে বই, রংতুলি, সঙ্গীত দিয়ে ঘেরা তাঁর চেয়ারটা খালি হয়ে যাবে। একইসঙ্গে অভাবনীয় এবং মন ভেঙে দেওয়ার মতো।
তাঁর প্রথম ছবি করার পর ৬০ বছর পার হয়ে গিয়েছে, এবং তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় ৩০ বছর, তবু তাঁর তৈরি ছবি আজও আমাদের চেতনা, আমাদের আলোচনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে, দেশে-বিদেশে সমাদৃত। এর কারণ শুধু তাঁর শৈল্পিক প্রতিভা নয়, তাঁর অন্তর্নিহিত মানবতাও। মাণিকদার উত্তরাধিকার অত্যন্ত সমৃদ্ধ, কিন্তু আমাকে যা আজও সবচেয়ে মুগ্ধ করে, তা হলো তাঁর ছবিতে নারী চরিত্র। তিনি কখনোই তাঁর নারী চরিত্রদের কাছ থেকে তাদের বাছবিচারের ক্ষমতা নিয়ে নেন নি। তাঁর নারীরা নিজেদের জোরেই প্রধান চরিত্র হয়ে উঠত, যা তখনকার সময়ের রীতি ছিল না। হয়তো এর নেপথ্যে ছিল তাঁর নিজের জীবনে দুই শক্তিশালী নারীর উপস্থিতি - তাঁর মা, যিনি একা হাতে তাঁকে মানুষ করেন, এবং তাঁর স্ত্রী, যিনি ছিলেন তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনের সঙ্গী ও সমালোচক।
মাণিকদার সমস্ত নারী চরিত্রের মধ্যেও সবচেয়ে প্রথমে যার কথা মনে হয়, সে পথের পাঁচালীর সর্বজয়া, দারিদ্রের ঝড়ঝাপটায় বিধ্বস্ত, তবু ভাগ্যের আঘাত সামলে অবিচল। হিন্দি সিনেমায় যুগটা ছিল মাদার ইন্ডিয়া (১৯৫৭), প্যায়াসা (১৯৫৭), এবং মুঘল-এ-আজম (১৯৬০)-এর মতো ছবির, এবং প্রতিটিতেই দেখা গিয়েছিল কিছু আইকনিক নারীচরিত্র। বাংলায় ছিল ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)। 'মেলোড্রামা'-কে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ঋত্বিক, তবে একথা অনস্বীকার্য যে তাঁর নারীচরিত্ররা সে যুগের হিন্দি ছবির আইকনিক নারীদের মতোই কার্যত 'মাতৃরূপী দেবী' হয়ে উঠত।
মাণিকদার সঙ্গে তফাতটা স্পষ্ট - সর্বজয়ার ক্ষেত্রে না আছে কোনওরকম 'সেলফ-পিটি' বা নিজের ওপর করুণা, না তার অবিচলতার গুণগান। এর ঠিক বিপরীতে রয়েছে ছটফটে দুর্গা - সদা কৌতূহলী, সদাই অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে, সবসময়ই বিপদ ডেকে আনা, এবং মাঝেমাঝে অন্য জগতে পালিয়ে যেতে চাওয়া। ছোটভাই অপুকে সবসময় রক্ষা করা এই দস্যি মেয়েটি নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন নিয়েই মারা যায়, কিন্তু তার অভাববোধ রয়ে যায় অপুর জীবনে, গোটা ট্রিলজি জুড়েই। .
তারপর রয়েছে ইন্দির ঠাকরুন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, সারা গায়ের চামড়া কুঞ্চিত। তার প্রায় প্রতিটি ভঙ্গিমাই আমাদের মনে গেঁথে আছে - ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে সর্বজয়ার খাওয়া দেখা, সব ছাপিয়ে তার আত্মরক্ষার প্রবণতা, সমস্ত অপমান সহ্য করেও মানুষের দোরে দোরে গিয়ে পেট চালানো, গোগ্রাসে নিজের খাবারটা খেয়েও একটি তুচ্ছ গাছকে সযত্নে লালন করা, এবং অপু-দুর্গার প্রতি তার স্নেহ।
মাণিকদার সঙ্গে আমার প্রথম ছবি অপুর সংসার (১৯৫৯)। এবং প্রথম যে দৃশ্যের শুটিং হয়, তা হলো অপু তার নতুন বৌ অপর্ণাকে নিজের ছোট্ট এক-কামরার বাড়িতে নিয়ে আসছে। প্রথমে আমরা দেখি, কেমন গুটিয়ে আছে অপর্ণা। নিজের বাড়ির আশ্রয় ছেড়ে, এক সদ্য পরিচিত পুরুষের সঙ্গে। পরিস্থিতির চাপে কেমন যেন দিশেহারা। কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা দেখতে পাই, নতুন জীবন মেনে নিতে নিতে শক্ত হচ্ছে তার মন। এই অদ্ভুত প্রেম এবং আশার যে অনুভূতি, তা অপুর সংসার-এর এক অন্যতম উপাদান। আজ ৬০ বছর পরেও ফুরিয়ে যায়নি ছবিটার রোম্যান্স।
এর পর আমি করি দেবী (১৯৬০), এক ধর্মান্ধ সামন্ততান্ত্রিক জমিদারের তাঁর পুত্রবধূকে 'দেবী' বানিয়ে তোলার কাহিনী। দয়াময়ীর চরিত্রে আমি ছিলাম ধর্মীয় গোঁড়ামির শিকার, কিন্তু দেবীর সাজপোশাক পরেও, গলায় ফুলের মালা দিয়েও, তার সঙ্গে ঠিক কী ঘটছে তা তার স্তম্ভিত মাথায় না ঢুকলেও, দয়াময়ী একবারের জন্যও ভাবতে পারে না যে পরিবারের মাথা, তার শ্বশুরমশাই, ভুল করতে পারেন। বিভ্রান্ত, দিশেহারা, অল্পবয়সী মেয়েটি আত্মরক্ষার্থেও ভাবতে পারে না বিদ্রোহ করার কথা। এই যে যৌক্তিকতার অবশতা, তা পুরুষতন্ত্র দ্বারা চালিত ব্যবস্থায় আজও দেখি আমরা। দয়াময়ীর মতো আরও বহু মেয়ে আজও মুখ বুজে সহ্য করে চলেছে পরিবার, প্রথা, সংস্কৃতি, এবং সম্মানের নামে অন্যায়-অনাচার।
অপুর সংসার করতে গিয়ে সেটে বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকতাম, কিন্তু দেবী-র সময় যেন কী একটা ভার চেপে বসত আমার ওপর। দমবন্ধ ভাবটা কিছুতেই এড়াতে পারতাম না। ঠিক যেন দয়ার ওপর যে চাপ তৈরি করা হচ্ছিল, তা আমাকেও সংক্রমিত করছিল। আমার ধারণা মাণিকদা সকলকে বলে দিয়েছিলেন আমার সঙ্গে কথা না বলতে, তিনি চেয়েছিলেন আমি একা বোধ করি। আমার অভিনীত চরিত্রের ক্ষেত্রে অসাধারণ কাজ দিয়েছিল এই পন্থা।
আমি তখন আরাধনা (১৯৬৯) ছবির আউটডোর শুট করার মুখে, সেই সময় মাণিকদা ফের আমায় ফোন করলেন। এবারও চরিত্রের নাম অপর্ণা, ছবির নাম অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০)। তবে এই অপর্ণা অপুর সংসারের অপর্ণার মতো নয়, সে আধুনিক, শহুরে, শিক্ষিত মেয়ে। যেমন নায়ক (১৯৬৬) ছবিতে অদিতি, তেমনি এই ছবিতেও আমি "বিবেকের" ভূমিকায়। অপর্ণার যুক্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে দিয়েই প্রধান পুরুষ চরিত্র খুঁজে পায় তার মানবিকতা।
মাণিকদার নারী চরিত্ররা অগুন্তি বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়: প্রথা-বিজড়িত দয়াময়ীর ধর্মান্ধতার কাছে সমর্পণ, মহানগরে (১৯৬২) অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাহিদা, নিজের ইচ্ছেমত বিয়ে করার স্বাধীনতা <কাপুরুষ, ১৯৬৫; সমাপ্তি (তিন কন্যা, ১৯৬১)>, নিষিদ্ধ কামনা (চারুলতা, ১৯৬৪; সীমাবদ্ধ, ১৯৭১; অরণ্যের দিনরাত্রি), এবং অসম, পুরুষতান্ত্রিক দুনিয়ায় নিজের সম্মান বজায় রাখার তাগিদ (অরণ্যের দিনরাত্রি, মহানগর, নায়ক)।
যেভাবে নিজেদের মানসিক, শারীরিক, ও বৌদ্ধিক চাহিদা প্রকাশ করেছে এইসব নারীরা, তা সত্যিই অনন্য। ভারতে নারী আন্দোলন শুরু হওয়ার অনেক আগেই স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় মহানগরের আরতি। স্রেফ স্বামীর ইগোতে লাগছে বলে নিজের চাকরি ছাড়তে অস্বীকার করে সে। ঠিক একইভাবে যখন সে চাকরি ছেড়ে দেয়, তখন তার নেপথ্যে থাকে এক মহিলা সহকর্মীর প্রতি কর্তৃপক্ষের অবিচার। ছবির শেষ দৃশ্যে যখন প্রকাশ্যেই হাত ধরাধরি করে কলকাতার ভিড়ে ঠাসা রাস্তায় হাঁটছে আরতি এবং সুব্রত, মনে হয় যেন লিঙ্গ সাম্যের এক নতুন যুগের সূচনা করছেন পরিচালক।
কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২) ছবিতে মা ও মেয়ের বহুবছরের পুরুষ শাসনের বিরুদ্ধে নীরব বিপ্লব নিঃসন্দেহে বড়পর্দায় দেখা মৃত প্রথার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর এক অন্যতম পরিস্ফুটন, যা অত সংযত বলেই অত শক্তিশালী। তেমনি চারুলতায় প্রধান নারী চরিত্রের কোনও বিবেকের দংশন হয় না। তার প্রেম সম্পর্কে সে অনুতপ্ত নয়। স্রেফ এই একটি কারণেই সমসাময়িক ছবির তুলনায় অতটা আলাদা ছিল চারুলতা।
অথচ সত্যজিৎ রায়ের কোনও ছবিই কিন্তু আগ্রাসী রকমের নারীকেন্দ্রিক বা পুরুষ-বিরোধী বা সমাজ-বিরোধী নয়। মনে রাখতে হবে, ঘরে বাইরে (১৯৮৪) ছবিতে নিখিলই কিন্তু প্রথম তার স্ত্রী বিমলাকে উৎসাহ দেয় অন্দরমহল ছেড়ে বেরোনোর। যার ফলে বিমলা আবিষ্কার করে গৃহবধূর আড়ালে লুকিয়ে থাকা তার নিজস্ব সত্তাকে, যদিও এই বিবর্তনের মূল্যও দিতে হয়।
এ নিয়ে অনন্তকাল বলা যায়, তবে একজন মহিলা দর্শক হিসেবে বড়পর্দায় নারীর এই চিরস্থায়ী চিত্রগুলি একাধারে মনে শক্তিসঞ্চার করে, এবং অভিভূত করে।
(প্রখ্যাত অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন-এর প্রাক্তন অধিকর্তা)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন