Puratawn: একটা করে জন্মদিন আর জীবনের আরও একটা বছর পার। সময়ের স্রোতে কখন যে চোখের সামনে বয়সটা বেড়ে যায়, মাথার চুলে পাক ধরার পর্যায়টা সেটা যেন মেল ট্রেনের গতিবেগের চেয়েও বেশি। সেদিন যে মেয়েটা স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করত আজ সেই মেয়েটা অফিস-বাড়ি সামলে নিজের জন্য হয়তো ন্যূনতম সময়টাও পায় না। বয়সের ক্লান্তি যখন গ্রাস করে তখন বোধয় মেয়েবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। ফেলে আসা স্মৃতিগুলো যে বড্ড মধুর। কাজের চাপে ক্লান্ত শরীর-মন চায় ধুলো মাখা মলিন স্মৃতিগুলো হাতড়াতে। ছোট ছোট জিনিসগুলোর মধ্যেই যেন খুঁজে পাওয়া যায় প্রশান্তি। কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে যখন বার্ধক্য ছুঁয়ে ফেলে তখন ছোটবেলার ফেলে আসা দিনগুলোর গল্প মা-বাবা-ঠাম্মিদের মুখে আমরা শুনি। প্রতিটি ঘরের বাস্তব চিত্রকেই যেন গল্পের নিখুঁত বুনোটে সিনেমার পর্দায় পুরাতন- রূপে মেলে ধরেছেন পরিচালক সুমন ঘোষ।
পরিপাটি করে শাড়ি পরে হাসি মুখে সারাদিন ঘরের কাজ করে আমাদের মায়েরা। কিন্তু, তাঁরা টেরই পায় না কখন নিজের অজান্তে শরীরে রোগ বাসা বেঁধেছে। অনেকসময় পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে জল চলে আসে। বয়স বাড়লে নাকি মানুষ ছোটবেলায় ফিরে যেতে পছন্দ করে। প্রতিনিয়ত এই কথাগুলো কিন্তু, কাছের মানুষরাই আমাদের বলে থাকেন। পুরাতনে মা-মেয়ের এক চিরন্তন সম্পর্কের গল্পের মধ্যে সেই শোনা কথাগুলোই যেন বারবার জীবন্ত হয়ে উঠবে। স্মৃতিভ্রষ্টা এক বৃদ্ধা মহিলা শহরের কোলাহলের বাইরে নদীর ধারে ইটের গাঁথনি দেওয়া বাড়িতে থাকতে ভালবাসেন। মাঝে মাঝেই বাস্তব ভুলে অতীতে ফিরে যান। ছোট্ট মামণির জন্য স্কুলের টিফিন গুছিয়ে তাঁকে নিয়ে বাসট্যান্ডে আসার পরই নিজের মেয়েকে চিনতে পারেন না।
মায়ের এহেন আচরণ একজন মেয়েকে কতটা কষ্ট দেয় তার অসাধারণ উপস্থাপনা করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। মাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চিকিৎসকের পরামর্শও নেন। কিন্তু, শর্মিলার এই জীবনটা যে সত্যিই সুন্দর সে কথা ঋতুপর্ণাকে বোঝান তাঁর মনের মানুষ ইন্দ্রনীল। কেন ইন্দ্রনীল শর্মিলার জীবনকে হিংসে করেন? মানুষ ইচ্ছে করলেই তো প্রকৃত অর্থে অতীতে ফিরে যেতে পারে না। যেটা শর্মিলা পেরেছেন। ১৯৭৪ সালের ব্যাঙ্কের বই, পুরীর লাঠি, রেডিও, দম দেওয়া ঘড়ি, মুদির দোকানের বিল, সমুদ্রে ঘুরতে যাওয়া সাদা-কালো জমানার অ্যালবামের ছবিগুলোতেই তাঁর সর্বসুখ। ধুলো মিশ্রিত, ময়লা, জং পড়ে যাওয়া জিনিসগুলো যা হয়তো আজ অচল, মূল্যহীন, কিন্তু সেগুলো হাতে নিয়ে যখন পৌঁছে যাবেন সেই ছোট্টবেলায় সেই স্মৃতি বা অনুভূতি আপনাকে দেবে একরাশ আনন্দ।
নতুনের মাঝে পুরাতন কতটা মূল্যবান সেটাই চিত্রায়িত হয়েছে সুমনের ছবিতে। এক প্রবাসীর মন কী ভাবে শিঁকড়ের টানে 'পুরাতন'-এর গন্ধ গায়ে মেখে ছবি তৈরি করতে পারেন তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই ছবি। পুরনো বাড়ির দেওয়ালের সরীসৃপ শিকড় এক স্মৃতিভ্রষ্ঠা বৃদ্ধার শরীরে শিরা-উপশিরায় প্রতিটি রক্তবিন্দুতে যেন মিশে রয়েছে। সময় থমকে না থাকলেও পুরানো দিনের নস্ট্যালজিয়াতেই বেঁচে থাকতেই পছন্দ করেন ওই বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা। সত্যিই এই ছবির অন্যতম আকর্ষণ নস্ট্যালজিয়া। অতীত আঁকড়ে বেঁচে থাকা, স্মৃতির ওম গায়ে মেখে একজন কতটা আনন্দ পায়. স্মৃতি-বিস্মৃতির উতল হাওয়ায় সুমন সরকারের মাস্টার পিস 'পুরাতন'।
এই ছবির শিক্ষণীয় বিষয়, সমাজের স্রোতে গা ভাসিয়ে চলতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। হ্যাপি বার্থডে-র তালেই জন্মদিন পার্টি উদযাপন করা বাধ্যতামূলক নয়। বরং একজন মানুষ যদি ব্যক্তিগত পরিসরের বাইরে পিছনে ফেলে আসা অতীতে সুখ খুঁজে পায় তাঁকে সেটা দিয়েই সন্তুষ্ট করা উচিত। মানসিক ব্যধির তকমা দিয়ে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আজকের ব্যস্ত জীবনে সোনালি অতীত যদি মুখে হাসি ফোটাতে পারে তাহলে মন্দ কী! ধুলো জমে থাকা হারমোনিয়ামে যদি রবীন্দ্রসংগীতের সুর তোলা য়ায় আর স্মৃতিভ্রষ্টা মায়ের প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের স্মৃতিতে ফিরে আসে ছোটবেলায় মায়ের সেই ঘুম পাড়ানি গান...পুরাতনের ছোঁয়ায় এভাবেই অনায়াসেই মিলবে মুক্তি।