সঙ্গীতশিল্পী কেকে-র (Singer KK Death) আকস্মিক প্রয়াণ অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল। বিশেষ করে, কাঠগড়ায় উঠল অনুষ্ঠান উদ্যোক্তাদের দায়বদ্ধতা। খ্যাতনামা শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের জন্য যথাযথ বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব কি আয়োজকদের নয়? কিংবা শো চলাকালীন শিল্পীদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা? সেই বিষয়ে তত্ত্বাবধান করার দায়িত্বটা-ই বা কার কাদের বর্তায়? বুধবার নজরুল মঞ্চে কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ-এর লাইভ পারফরম্যান্সের সময়ে ঠিক কী ঘটেছিল? সেই বিষয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে নেটদুনিয়ায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ মূলত দুটি বিষয় নিয়ে। প্রথমত, আড়াই থেকে তিন হাজার দর্শকাসন থাকা সত্ত্বেও কেন সাত-আট হাজার শ্রোতাকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল অডিটোরিয়ামের ভিতর? দ্বিতীয়ত, এত সংখ্যক মানুষ থাকা সত্ত্বেও বন্ধ করে দেওয়া হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র। দমবন্ধ করা পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। আর ঠিক এমন 'গোলযোগ' নিয়েই অনুষ্ঠান উদ্যোক্তাদের কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছে নেটিজেনরা।
কেকে-র মতো শিল্পীর অনুষ্ঠানেও যদি এহেন অচলায়তন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতেও তো এই একই ঘটনার পুরনাবৃত্তি ঘটতে পারে। এই বিষয়ে রীতিমতো আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে।
মে মাসের গোড়ার দিকে ভবানীপুরে শো করতে গিয়ে রূপম ইসলাম (Rupam Islam) মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যেই উদ্যোক্তাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। চড়া আলো। ভ্যাপসা গরম। ফ্যান নেই। ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর নিয়ে শোয়ের মাঝেই উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে বলেন- 'স্টেজে নিশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না'। এহেন দৃশ্য খুব একটা অপরিচিত নয়। বুধবার কেকে-র শোয়ে নজরুল মঞ্চের উপচে পড়া ভীড় ও উদ্যোক্তাদের তা সামাল দিতে না পারা নিয়ে ফের সরব হন রূপমের স্ত্রী রূপসা দাশগুপ্ত। তাঁর সপাট প্রশ্ন, স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো কি বুঝতে পেরেছিলেন কেকে-র শেষমুহূর্ত কতটা কঠিন ছিল? কিংবা অনুষ্ঠানের আয়োজক, নিরাপত্তারক্ষীরা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, যে অডিটোরিয়াম ২ হাজার লোকের জন্য, সেখানে অতিরিক্ত শ্রোতাদের কেন ঢুকতে দেওয়া হয়েছে? এই ঘটনার পরও কি নজরুল মঞ্চ কর্তৃপক্ষের হুঁশ ফিরবে? রূপসার কথায়, আর্টিস্ট ম্যানেজারদের এবার থেকে আরেকটু কড়া হওয়া প্রয়োজন। এরকম পরিস্থিতি দেখলেই মুখের ওপর জানিয়ে দেওয়া উচিত যে, আর শো চালানো যাবে না।
সম্প্রতি রূপম ইসলাম ২টি শো করেন নজরুল মঞ্চে। যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে জীবনের শেষ শোটা করে গেলেন কেকে। অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে ফসিলস-ফ্রন্টম্যান জানান, "নজরুল মঞ্চ ওভারক্রাউডেড হয়ে গেলে কী হয়, সে অভিজ্ঞতা আছে। এসি বন্ধ হয়ে যায়। মঞ্চেও সার বেঁধে দর্শক দাঁড়িয়ে থাকলে দম নেওয়ার ফাঁকটুকুও থাকে না। কয়েকদিন আগে এরকমই এক অনুষ্ঠানে রকসংগীত পরিবেশন করেছিলাম। অভ্যেস না থাকলে পারা মুশকিল। এ নিয়ে কয়েকটি মন্তব্য করেছিলাম। এখন হয়তো কেউ কেউ বুঝবেন। কতটা শারীরিক কষ্ট সহ্য করে আমাদের পারফর্ম করতে হয়। ঠান্ডার দেশ তো আর নয়!"
সেই প্রসঙ্গ টেনেই রূপসা বলেন, "বদ্ধ অডিটোরিয়ামের ভিতরে ৬ হাজার লোক। এমনকী, মঞ্চে অন্তত ১০০জন। এদিকে এসি কাজ করছে না। এই ব্যাপারে অভিযোগ করলেই উদ্যোক্তাদের তরফে একটাই উত্তর- এত লোক এসি কাজ করবে কী করে?" কেকে-র ঘটনায় তাঁর আক্ষেপ, "আমি দুঃখিত যে কলকাতা ওঁর শেষ পারফরম্যান্সের মধুর স্মৃতি তৈরি করতে পারল না।" সরকারের তরফে যেন এই বিষয়ে নজর দেওয়া হয়, সেই আর্জিও জানান রূপম ইসলামের স্ত্রী রূপসা দাশগুপ্ত।
<আরও পড়ুন: ‘জাতীয় পুরস্কার পাওয়া-ই কাল হয়েছে..’ KK-মৃত্যুতে রূপঙ্করকে তুলোধনা রূপাঞ্জনার>
অনুপম রায় (Anupam Roy) বললেন, "আমার ম্যানেজমেন্ট টিম যদিও গোটা বিষয়টা দেখে। ওরাই অনুষ্ঠান উদ্যোক্তাদেরকে আগে থেকে বলে দেয় কী দরকার। তবে হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে এরকম অসুবিধের সম্মুখীন তো হতেই হয়। প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই আমাদের শো চালিয়ে যেতে হয়। এটা নতুন নয়। আমি যখন প্রথম চাকরি ছেড়ে আসি, আমি তখন অনেককিছু দেখেই অবাক হয়েছিলাম। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। এটা আসলে ভীষণ ডিসঅর্গানাইজসড একটা সেক্টর। আমরা চেষ্টা করছি বহুদিন ধরে সবকিছুকে নিয়মে আনার। যেমন, গোড়ার দিকে আমার কোনও টেক রাইডার ছিল না। এগুলোর চলই ছিল না এখানে। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা তখন টেক রাইডার কী? সেই বিষয়টার সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন না। ভাবতেন- শিল্পী আসবে, মাইকে গান গাইবে, চলে যাবে। আমাকেও এরকম প্রতিকূলতার মধ্যে শো চালাতে হয়েছে। কেকে-র ঘটনাটা সত্যিই দুঃখজনক। তবে আমার মনে হয় না, এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরও কোনও হেলদোল থাকবে লোকজনের। দিন কয়েকের জন্য বিষয়টাকে গম্ভীরভাবে নিলেও পরে আবার সেই গতানুগতিক পদ্ধতিই চলবে। এখানকার কথা বাদ দিলেও প্যারিসে আন্তর্জাতিক স্তরের ফুটবল ম্যাচেও এমন বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে সম্প্রতি। নির্ধারিত সময়ের ৩৬ মিনিট বাদে ম্যাচ শুরু হয়। কারণ কমেন্টেটর থেকে দর্শকরা কেউই স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারেননি। আমাদের এখানকার কথা তো ছেড়েই দিলাম, দেশে-বিদেশেও এমন গণ্ডগোল হয় পাবলিক ইভেন্টে।"
শো করতে গিয়ে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার কথা উঠে এল গায়ক শিলাজিতের (Silajit) স্মৃতিচারণাতেও- "ভেবেই যাচ্ছি কতবার মরে যেতে পারতাম। একেকটা শোয়ের কথা মনে পড়ছে। সেই প্রথম দিককার একটা শো। পুরুলিয়া আদ্রা। কোনও অডিটোরিয়াম ছিল না। আউটডোরে কোনও গ্রিনরুম নেই। শো শেষে ঢোকানো হল একটা ক্লাসরুমে, যেখানে খুব বেশি হলে পঞ্চাশটা লোক ধরতে পারে। দরজাতে খিল ছিটকিনি নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘরের মধ্যে দুশো ছেলেমেয়ে। সবাই বলছে সবাইকে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু কেউ বেরোচ্ছে না। চন্দ্রকোনা রোড। ঘামে ভারী হয়ে যাচ্ছিল জামা-জিন্স সব। ঘণ্টা তিনেকের পারফরম্যান্সের পর যে ঘরটায় আমাদের দলের জন্য বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেটাতে কোনও জানালা নেই। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে দৌড়লাম। শরীর দিচ্ছে না। কত মানুষ যে তখন অটোগ্রাফের জন্য আমার পেছনে দৌড়চ্ছে। ভাবলাম, কোনও রকমে পালিয়ে যাব। গাড়িতে উঠতে যাওয়ার আগে কলাপসিবল গেটের রডে ধাক্কা খেলাম কপালে। পড়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম মরেই যাচ্ছি বোধহয়। মুহূর্তের মধ্যে শরীরে যতটুকু শক্তি ছিল, যতটা বুদ্ধি কাজ করছিল, বুঝলাম জ্ঞান হারানোর আগে আমাকে যে ভাবেই হোক গাড়িতে উঠতে হবে। নইলে ভীড়ের চাপেই হয়তো মরে যাব। শক্ত প্রাণ ছিল বয়স কম ছিল। জেদ ছিল যুবকের মত। উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। আজ হলে আমার নিজেকে বাঁচানোর শক্তি হত না।"
<আরও পড়ুন: ‘হায়! এহি পে মর যাউ..’ মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে স্টেজেই ইঙ্গিত দেন KK, দেখুন সেই ভিডিও>
তারপর? বিষ্ণু বলে শিলাজিতের এক ডাক্তার বন্ধু সেদিন যিনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন, তিনি হোটেলে ফিরে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস একটু সহজ হওয়ার পর বলেছিলেন গায়ককে- আপাতত বেঁচে গেছিস। বাকিটা কাল। যদি বেঁচে থাকিস কলকাতা পৌঁছে মাথার ছবি তুলতে হবে। এখানে তো সম্ভব না। জঙ্গিপুরে আরেক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা শিলাজিতের। বললেন, "হাজার হাজার মানুষ। ব্যারিকেড ভেঙে গেছে। তার একটু আগে প্রণববাবু তাঁর Z ক্যাটাগরির নিরাপত্তা নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। পরক্ষণেই অর্গানাইজার কারা বুঝতেই পারছিনা। সবাই দর্শক। এরকম পরিস্থিতি শুধু আমার হয়নি, আমার থেকেও জনপ্রিয় শিল্পীরা আছেন, যাঁদের দেখতে জনস্রোত তৈরি হয়ে যায় যাদেরকে মানুষ ছুঁতে চায়। আদর তখন অত্যাচারে পরিণত হয়। অভদ্রতা করে ফেলার ভয়ে, মেনে নিতে হয়। সময় বদলেছে, মানুষ বদলায়নি। কেকে-র ভিডিও দেখে ভাবছি, যদি এরকম পরিস্থিতিতে আমি বা রূপম পড়তাম, তাহলে তো আমরা মঞ্চেই লাশ হয়ে যেতাম।"
অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ও সোচ্চার। তাঁর মন্তব্য, "শিল্পের নামে এই গুন্ডামি বন্ধ হোক। আমরা শিল্পীরা কি এগিয়ে এসে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারি না? আর দয়া করে কেকে-র মৃত্যুটাকে এসব বলে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করবেন না যে- কী দারুণ চলে যাওয়া, গান গাইতে গাইতে চলে গেল, প্রকৃত শিল্পী.. ইত্যাদি ইত্যাদি।"
আরেক সঙ্গীতশিল্পী কিঞ্জল চট্টোপাধ্যায়েরও অভিযোগ, "উদ্যোক্তারা শিল্পীদের কথা ভাবেন না। নইলে নজরুল মঞ্চে অত লোক ঢুকলো কী করে? আর কেকে যখন বলছেন, তাঁর এত আলোর দরকার নেই। বারবার জল খাচ্ছেন। তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছছেন। এসি কাজ করছে না। এইসময়ে উদ্যোক্তারা কী করছিলেন? দর্শক হোক বা অনুষ্ঠানের আয়োজক, কারোর-ই কি শিল্পীদের শারীরিক পরিস্থিতির দিকে নজর থাকবে না? তাঁর কথায়, অত অস্বস্তির মধ্যেও কেকে পারফর্ম করে গিয়েছেন। চাইলে মঞ্চ ছেড়ে চলেই যেতে পারতেন। কিন্তু যাননি। কারণ তাঁর কাছে আগে গান, পেশাদারিত্ব।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন