ছবি: সোনার পাহাড়
পরিচালক: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়: তনুজা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, পরমব্রত, শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণিমা ঘোষ, গার্গী রায়চৌধুরী
রেটিং: ৩/৫
পর্দায় তাকিয়ে আপনার চোখের কোণটা চিকচিক করে যদি গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে কিংবা কোনও এক দৃশ্যে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টের পান, বুঝতে হবে ছবিটা মন টেনেছে। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের 'সোনার পাহাড়' দেখে কিন্তু এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সত্তর বছরের উপমার বাথরুমে পড়ে যাওয়া দিয়ে গল্পের শুরু। মা, ছেলে এবং বৌমার মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নেই, তাই তাঁরা আলাদা থাকেন। অভিমান আর জেদের পাহাড় জমে। জেনারেশন ওয়াইয়ের ব্যস্ততা দরুন একদিনও ছেলে-বউ সময় দিতে পারেন না বৃদ্ধা মাকে। তাই, উপমার চিকিৎসা এবং সময় বাঁচানোর সহজ সমাধান হিসেবে ছেলের বউ মৌ আনন্দঘর নামক সেচ্ছাসেবী সংস্থার শরণাপন্ন হন। এইচ আই ভি পজিটিভ বাচ্চাদের দেখভাল করেন রাজদীপ এবং তাঁর এই সংস্থা। আর আনন্দঘরের মাধ্যমেই আলাপ হয় উপমা এবং বিটলুর। বিটলুর 'উমা' অর্থাৎ উপমার ছিন্নপত্র জীবনে রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল হয়ে আসে ওই এইচ আই ভি পজিটিভ শিশু। এরপর একে একে ম্যারিয়ট, গাড়ি চালাতে শেখা, এবং ক্যাপ্টেন হ্যাডকের হাত ধরে বাড়তে থাকে দুজনের বন্ধুত্ব, অসমবয়সী বাঁধন।
আরও পড়ুন: উপমার চরিত্রটা ‘আহারে কি মিষ্টি বুড়ি’ গোছের নয়: পরমব্রত
উমা যে কিশোর গল্প লিখতেন, বিটলুর কাছে রূপকথার মতো লাগে সেই গল্পগুলো। ধুলো ঝেড়ে বিটলুই তো উদ্ধার করে জীর্ণ খাতার আড়াল হয়ে যাওয়া উপমাকে। যে বই উপমা কোনওদিন ছাপিয়ে উঠতে পারলেন না। তবে জীবনের ভাল সময় তো মরীচিকার মতো, শেষ হতেই হয়, ফিরতেই হয় বাস্তবে - উপমা, সৌম্য, রাজদীপ, মৌ, বিটলুরও তাই হয়। বাঁধন-না-মানা বাঁচার মন্ত্রে, 'খিটখিটে বৃদ্ধা' উপমার নিজেকে ফিরে পাওয়ার যাত্রা, টুনটুনির বই, আবোল তাবোলের হাত ছাড়িয়ে বড় হয়ে যাওয়া ছোট ছেলেটাকে বীরপুরুষের বেশে ফিরে আনার বুঝি রাস্তা নেই। তাহলে কী মা-ছেলের দূরত্ব পেরোতে না পারার যন্ত্রনা থেকে যাবে? সত্তর আর সাতের যুগলবন্দী কি পাড়ি দেবে না সোনার পাহাড়ের গুপ্তধনের খোঁজে?
'সোনার পাহাড়' আপনার পর্দায় সুন্দর, গোছানো গল্প দেখার সাধ মেটাবে। পাভেল এবং পরিচালকের কলমে স্ক্রিনপ্লে জীবন্ত হয়েছে ৭০ মিলিমিটারে। আজও, সৌমিত্র-তনুজা নিমেষে আপনাকে নিয়ে যেতে পারেন 'তিন ভুবনের পারে' রূপকথার দেশে, সব পেয়েছির আসরে। ছোট্ট বিটলু ওরফে শ্রীজাত সাবলীল, চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে সময়ে সময়ে কিঞ্চিৎ অকালপক্কও বটে, কিন্তু সেটা ছাপিয়ে চোখে পড়বে ওর দুরন্ত চাহনি আর সংলাপ। একটুও বাড়তি অভিনয় না করে যিশু, পরম, অরুণিমা যথাযথ।
ছবির সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্বে শুভঙ্কর ভড়। চায়ের কাপের ধোঁয়া ওঠার সাধারণ ক্লোজ শটও মন ভাল করে দেবে। পুরো ছবিতে কোথাও অপ্রয়োজনীয় আড়ম্বর নেই - না আর্ট ডেকরে, না পোশাকে, না লোকেশনে, না মেকআপে, না গানে। কমিক রিলিফও মাপা। একেবারে পাকা পরিচালকরে মতো সবটা সামলে নিয়েছেন পরম। তাঁর মা সুনেত্রা ঘটকের কিশোর গল্পের পাপন, যে অনেকটাই পরম, তা থেকে বেরিয়ে আসেননি পরিচালক।
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এই ছবির শক্তিশালী হাতিয়ার। নীল দত্ত যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এবং অনুপমের গাওয়া, ইমন চক্রবর্তীও রয়েছেন। কম্বিনেশনেই বুঝতে পারছেন গান কেমন হতে পারে! পরিচালক সবকিছুর শেষে সবটা ঠিক হওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। রবি ঠাকুরের কথায় বলেছেন: 'ভয় পেয়েছ – ভাবছ, "এলেম কোথা।" আমি বলছি, "ভয় কোরো না মাগো, ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।"'