সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরেছেন তাঁর নতুন কাকাবাবু ছবির শুটিংয়ের জায়গা পরিদর্শন শেষ করে। সামনে পর পর তিনটে ছবির কাজ। তবুও কপালে ভাঁজ নেই এতটুকু। অবলীলায় একের পর এক সাক্ষাৎকার দিয়ে চলেছেন। 'ভিঞ্চি দা' থেকে বিতর্ক, সবকিছু নিয়েই কথা বললেন 'টলিউডের ফার্স্ট বয়' সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
প্রতিশোধ এবং রহস্য এক করে ফেললেন কীভাবে?
যেরকম আগে সন্তানের প্রসব, পরে নামকরণ। সেভাবেই চিত্রনাট্য লেখার পর বোঝা যায় সেটা কোন জঁরে (genre) পড়বে। অনেক ভেবেচিন্তে থ্রিলার ও রিভেঞ্জ ড্রামা, এই দুটো বিভাগে 'ভিঞ্চি দা'-কে ফেলতে পেরেছি। তবে ছবিটা 'বাইশে শ্রাবণ' কিংবা 'চতুষ্কোণ'-এর মতো কে করেছে, এই প্রশ্ন তোলে না। ছবিটা কীভাবে আর কেন নিয়েই কথা বলবে।
রুদ্রনীলের কাছে গল্পটা শোনার পর প্রথম কী মনে হয়েছিল?
গল্পটার একটা অংশ খুব ভাল, কিন্তু অন্যদিকটা খুব একটা জমছে না। সেই কারণেই নিজে অবতীর্ণ হলাম সিরিয়াল কিলারের কাহিনীটা নিয়ে। প্রেমের একটা বড় ভূমিকা ছিল, সেটাকে বর্জন করে কেবলমাত্র মেকআপ আর্টিস্টের জীবনীটা নিই (যেটা রুদ্র সোমনাথের ওপর ভিত্তি করে লিখেছিল)। ক্রাইম, পুলিশ এসব নিয়ে তো আমার মোহ রয়েছেই।
অন্যের গল্প নিয়ে তো সৃজিত মুখোপাধ্যায় সাধারণত ছবি করেন না। আর করলেও সেটার ভাল-খারাপ কী মনে হয়?
এটা সম্পূর্ণ অন্য কারোর গল্প বলা যাবে না। বীজটুকু নিয়ে রুদ্রর সঙ্গে মিলে বিষয়টা লালন-পালন করেছি। এর আগে শেক্সপিয়ার আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনীর বীজ নিয়ে একটা গল্প তৈরি করেছিলাম। ওকে বলছিলাম, শেক্সপিয়ার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর রুদ্রনীল এখন এক ব্র্যাকেটে। শুনে তো রুদ্র প্রায় ভিরমি খায়!
আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, ভাল দিক হল আপনার ফেরার জায়গা রয়েছে, আর খারাপ, ক্রেডিটটা ভাগ করে নিতে হয় (হাসি)।
রুদ্রকেই ভিঞ্চিদা হিসেবে কেন বাছলেন? আর ঋত্বিক সিরিয়াল কিলার!
আমার ওপর কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। ভিঞ্চিদার একটা হতাশা রয়েছে, সেটা রুদ্রর মধ্যেই অভিনেতা হিসেবে দেখেছি। একজন শিল্পী, যিনি নিজের যোগ্য সম্মানটুকু পাচ্ছেন না। সেটাকেই কাজে লাগিয়েছি। ফলে সেটা অভিনয় নয়, সত্যি হয়ে উঠেছে। আর সাধারণ মানুষের চরিত্র ঋত্বিকের থেকে ভাল কেউ করতে পারে না। সাধারণ মানুষই সিরিয়াল কিলার হয়, সেটা দারুণ করেছে। ও আলাদা করে 'আমি খারাপ', এটা দেখায় নি।
আরও পড়ুন, শিবপ্রসাদ-নন্দিতার পরের ছবিতে আবারও সামাজিক ইস্যু
ঋদ্ধি...
ও আমার পিঞ্চ হিটার। ওকে বলেছিলাম, বাকিরা ইনিংস খেলবে, তোকে আমি এক ওভার দেব, সুপার ওভার। ছ'বলে কত রান করতে পারিস। এবং ও ছ'বলে ৩৬ রান করেছে।
কিন্তু নগরকীর্তনের পর দর্শকের একটা আশা তৈরি হয়েছে ঋদ্ধিকে নিয়ে...
সে কারণেই চেয়েছিলাম 'নগরকীর্তন' হলে থাকতে থাকতে ট্রেলারটা রিলিজ করুক। যাতে দর্শক বোঝেন, যে পুটি করতে পারে, সে এটাও পারে। 'নগরকীর্তন'-এর মতো এত ভাল ছবি বিরল, কিন্তু সেখানে পুটির কথা মাথায় রেখেও বলছি, 'ভিঞ্চি দা'-য় ঋদ্ধির দুটো সিন বহুবছর আলোচিত হবে, ঠিক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের 'চতুষ্কোণ'-এ দুটো সিনের মতো।
এখন বাংলা ছবিতে পর্দার পেছনের চরিত্রগুলো সামনে আসছে, অনেক রকম বিষয় নিয়ে কাজও হচ্ছে। অথচ শোনা যাচ্ছে, ব্যবসা হচ্ছে না।
মেকআপ আর্টিস্ট বা টেকনিশিয়ানদের নানান থিম নিয়ে কাজ করতে দেওয়া, আর একটা ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য, দুটো ভিন্ন বিষয়। হ্যাঁ, আমরা বাজেট কাটছাঁট করতে পারি, এখন টেকনিশিয়ানরা অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে পারছেন, কিন্তু ব্যবসায়িক সাফল্যের নিরিখে এবছরের শুরুটা একদমই ভাল হয়নি। 'নগরকীর্তন' ও 'মুখার্জী দার বউ' ছাড়া আর কোনও ছবি রমরমিয়ে ব্যবসা করতে পারেনি। এইবার যে গরমের ছুটিটা আসছে তাতে পরপর অনেকগুলো ছবি আসছে, আশা করছি খেলাটা ঘুরবে।
শ্রীকান্ত মোহতা অনুপস্থিত, নান্দনিকভাবে উনি যেকোনও ছবিতে সাহায্য করতেন। সেই জায়গা থেকে কতটা অসুবিধেয় পড়লেন?
যাঁদের যাঁদের সহায়তা করে থাকতেন, তাঁদের তাঁদের ছবি আটকে গেছে। আর যাঁরা একটু স্বাবলম্বী ছিলেন, তাঁদের আটকায়নি। তাঁদের ছবি হচ্ছে, যেমন 'কাকাবাবু', 'ভিঞ্চিদা', যেমন পরবর্তীকালে 'গুমনামী'।
সৃজিত কতটা শান্ত হয়েছেন?
আমি তো প্রচন্ড ঠান্ডা, অনুপম তো গানও লিখে দিয়েছে 'শান্ত হও' (হাসি)। সেটেও অনেক হইচই, অনেক অ্যানার্কি, পরিকাঠামোগত অব্যবস্থা সত্ত্বেও শান্ত থাকতে পারি।
সয়ে গেছে...
তা গেছে, প্লাস একটা মৃত্যুভয় আছে। আমার ব্লাড প্রেসার ভীষণ হাই। সুতরাং, বেশি রাগ করলে মারা যেতে পারি। মরতে আমি চাই না, আরও কিছু ছবি করতে চাই। ফলে রাগটা সংযত করেছি।
আরও পড়ুন, কিয়া এন্ড কসমস-এর পাশে কতটা দাঁড়িয়েছে টলিউড? কী বললেন স্বস্তিকা?
আর বিতর্ক...
সে বহুদিন হয়ে গেল দাগ কাটে না। আপনি যখন জানেন সত্যিটা কী, ঘটনাটা কী, তখন দাগ...আর আমার মনে হয় বিতর্ক যেকোনও পাবলিক ফিগারের জীবনের একটা অংশ, সেটায় অভ্যস্ত না হলে নিজেরই ক্ষতি। চামড়াটা একটু মোটা করা দরকার, একগুচ্ছ লোক যে অকারণে ভালবাসছেন, আর একগুচ্ছ লোক যে ঘৃণা করছেন, কোনওটার সঙ্গেই কমফরটেবল হয়ে উঠলে চলবে না।
এই 'অকারণে ঘৃণা' করা মানুষগুলোকে একসময় ব্লক করতেন, আর এখন নিজের ছবির মিম শেয়ার করছেন...
না না! মিম হিউমারাস না হলে শেয়ার করি না। মাঝখানে একটা ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মধ্যে কেউ কেউ তৈরি করেছিলেন, কারণ তাঁদের নাম করে, টার্গেট করে ভৎসর্না করেছিলাম, শিড়দাঁড়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম।
একটা বাচ্চা মেয়ে হয়তো বেসুরে গান গেয়েছে, কিন্তু পেটের দায়ে। মৃত্যুশয্যায় পড়ে থাকা বাবার জন্য, সংসারের ভার তুলে নিতে করেছে। মনে হয়েছিল, মানবিকতার খাতিরে তার বেসুরো গান মাফ করে দিতে পারতাম কিন্তু করি নি, টার্গেট করেছি।
কিন্তু ব্লক করেন ...
মিম বা ট্রোলে কোনও আপত্তি নেই যদি সেটা হিউমারাস হয়। এই সূক্ষ্ম লাইনটা মানুষ ক্রস করে ফেললে সেগুলো শেয়ার তো করিই না, আর যাঁরা করেন তাঁদের ব্লক করি। দেখুন, আমি খুব পরোপকারী। আমার ছবি যাঁদের জীবনে বিরক্তির উদ্রেক করে, আমার অস্তিত্ব যাঁদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে, অত্যন্ত দায়িত্ববান নাগরিক হিসাবে তাঁদের জীবন থেকে নিজেকে মুছে দিই। তাঁদের ব্লক করি এই জন্য, যাতে কোনওভাবে বিরক্ত না করে ফেলি।
'গুমনামী বাবা' শুরুর আগেই চর্চায়...
হ্যাঁ! গুমনামী বিতর্ক জমে গেছে। একটাই কথা বলার আছে, নেতাজী কোনও পরিবারের সম্পত্তি হতে পারেন না। আমি সেই পরিবারের অংশ, স্বাধীন ভারতে যাঁরা নিঃশ্বাস নিচ্ছেন প্রত্যেকেই তাই। আর মতবাদ নিয়ে তাঁর পরিবারও তো দ্বিখন্ডিত। ওঁর অন্তর্ধান রহস্যের একটা থিওরি নিয়ে ছবি করছি। সংবিধান বলছে, আমাকে কেউ আটকাতে পারেন না এবং পারবেন না। ছবিটা করছি, অভিনেতাদের ডেট ঠিকমতো পেলে ২০২০-র জানুয়ারীতে সেটা মুক্তি পাবে।
'ভিঞ্চি দা' মুক্তির পর টলিউডে কি সৃজিত থ্রিলারে প্রথম নাম হবে?
দর্শক বলেন থ্রিলার ভাল বানাই। আমি ব্যাপারটাকে ওভাবে দেখি না। নথিভুক্ত করা যে এ ওটা ভাল পারে ...জানি না, জানেন। এসব নিয়ে অত ভাবি না। নিজেকে অত সিরিয়াসলি নিই না। ছবি বানাই, বেশিরভাগ ছবি এখনও পর্যন্ত মানুষের ভাল লেগেছে, কিছু লাগে নি, আমার কাছে এটুকুই। বাকিটা দর্শকের মূল্যায়ন।