পর্দার অভিনয় কঠিন। টেলিপর্দার অভিনয় একটু বেশিই কঠিন কারণ এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গল্পের শুরুটা জানা থাকে অভিনেতাদের, শেষটা নয়। সিনেমার ক্ষেত্রে, একজন অভিনেতা ফ্লোরে যাওয়ার আগে চরিত্রের জার্নিটা তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। টেলিভিশনে সোশাল ড্রামার ক্ষেত্রে বিশেষ করে, পরের সপ্তাহে ঠিক কী ঘটবে, চরিত্রের গ্রাফ কতটা বদলাবে তা অভিনেতারা জানতে পারেন না।
এছাড়া আরও একটি চ্যালেঞ্জ থাকে অভিনেতাদের। পর্দার অভিনয়ের অভিব্যক্তি অনেকটা নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে রাখতে হয় যা আবার শট অনুযায়ী বদলায়। ক্লোজ শটে একরকম আবার লং মাস্টার শটে অভিব্যক্তির তারতম্য করতে হয় অনেক সময়। এটাও মাথায় রাথতে হয় যে মঞ্চের অভিনয়ের টোন এখানে কাম্য নয়। অথচ, বাংলা টেলিপর্দায় বেশিরভাগ ধারাবাহিকেরই টোনটি একটু উচ্চকিত থাকে। সেক্ষেত্রে অভিনেতাদের একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হয়। অর্থাৎ ম়ঞ্চের মতো হলেও চলবে না আবার সিনের টোনটা ঠিক রাখতে হবে। কোনও দৃশ্যে হয়তো অত্যন্ত হাই-টোন ড্রামা রয়েছে। সেখানে অভিনয়ের সময় পর্দার উপযোগী অভিব্যক্তি যাতে মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, সেই দিকটা খেয়াল রাখতে হয়।
আরও পড়ুন: দক্ষিণের ফিল্মফেয়ার! সেরার তালিকায় কারা, এক নজরে
টেলিভিশনের মুখ্য চরিত্রগুলির মতোই পার্শ্বচরিত্রগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পার্শ্বচরিত্রে কৃতী অভিনেতা বা চরিত্রাভিনেতাদের বাদ দিয়ে যদি শুধুমাত্র মুখ্য চরিত্রের নায়ক-অভিনেতাদের ধরা যায়, তবে ২০১৯ সালে অনেকেই অত্যন্ত কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাই সেরা ৫ নির্বাচন খুবই কঠিন। বেশিরভাগ সোশাল ড্রামাগুলিতে নায়কের চরিত্রগুলি এমনভাবেই তৈরি করা হয়, যেখানে অভিনেতাকে খুব একটা নিজেকে ভাঙতে হয় না। তাই সব সময় অভিনেতারা তাঁদের দক্ষতা দেখানোর সুযোগও পান না। নীচের তালিকায় রয়েছেন সেই পাঁচ অভিনেতা যাঁরা এমন একটি চরিত্র পেয়েছেন যেখানে নিজেকে ভাঙতে হয় অনেকটাই, পাশাপাশি পর্দায় অভিনয়ের সূক্ষ্মতাও যথাসম্ভব ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা।
রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায় (আয় খুকু আয়, সান বাংলা)
সম্ভবত এখনও পর্যন্ত এটাই টেলিপর্দায় সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং চরিত্র রাহুলের কাছে। এক অটিজমে আক্রান্ত মানুষ যার মধ্যে অদ্ভুত এক পিতৃত্ব কাজ করে। তার মাথার বয়স এখনও আটকে রয়েছে শিশুকালে অথচ সে তিরিশ পেরনো একজন পুরুষ। সাধারণত অটিস্টিক মানুষের মুখে তেমন অভিব্যক্তি খেলে না। তাই যথাসম্ভব কম অভিব্যক্তি দিয়ে চরিত্রের যাত্রাটি তুলে ধরছেন রাহুল। একজন ভাল অভিনেতা চরিত্রটিকে তাঁর শরীরে ধারণ করেন। এই ধারাবাহিকের যে কোনও এপিসোডে কয়েক মিনিট রাহুলের অভিনয় দেখলেই দর্শক বুঝবেন যে তিনি কী অসীম দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রটিকে তাঁর শরীর-মনে ধারণ করেছেন।
রিজওয়ান রব্বানি শেখ (সাঁঝের বাতি, স্টার জলসা)
দৃষ্টিশক্তি হারানো এক মানুষের চরিত্রে অভিনয় নিঃসন্দেহে কঠিন। রিজওয়ান সেই কঠিন কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করছেন। এই চরিত্রটিতে অনেকগুলি ইমোশন মিলেমিশে থাকে। চরিত্রটি আপাত-শান্ত যেমন, তেমনই বেশ জটিল। আর্য্যমানের ভিতরে সারাক্ষণ দৃষ্টিশক্তি চলে যাওয়ার মানসিক যন্ত্রণা রয়েছে। অথচ সে একজন অত্যন্ত ভাল মনের মানুষ। তার ভিতরে নিরন্তর এই লড়াইটা চলে নিজেকে ইতিবাচক রাখার। স্ত্রীর একনিষ্ঠতা, যত্ন, শর্তহীন প্রেম তাকে যেমন আশ্বস্ত করে, শান্ত করে, তেমনই আর্য্যমানের ভিতরে কোথাও একটা অপরাধবোধ তলানিতে রয়ে যায় যে চারু একজন দৃষ্টিহীনকে বয়ে নিয়ে যাবে সারা জীবন। নিরন্তর টানাপোড়েনে থাকা, নম্র, অভিমানী এই নায়ককে যদি দর্শক ভালবেসে ফেলেন, তবে সেটা রিজওয়ানের অভিনয়গুণে।
আরও পড়ুন: শীর্ষে রইল ‘কৃষ্ণকলি’, চতুর্থ স্থানে ‘শ্রীময়ী’
সব্যসাচী চৌধুরী (মহাপীঠ তারাপীঠ, স্টার জলসা)
বামদেবের চরিত্রে এর আগে বহু অভিনেতাকে দেখেছেন দর্শক বাংলা টেলিপর্দায়। এই ধরনের চরিত্র সব সময়েই কল্পনাতীত কঠিন একজন অভিনেতার কাছে। প্রথমত, লার্জার দ্যান লাইফ একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। দ্বিতীয়ত, চরিত্রটির সম্পর্কে যা যা তথ্য পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই লোকমুখে প্রচলিত। তাই অনেকটাই পরিচালক ও চিত্রনাট্যকারের চরিত্র সম্পর্কে ভিশনের উপর নির্ভর করতে হয়। বামদেবের আড়ম্বরহীন আধ্যাত্মিকতা, মা তারার প্রতি তার অসীম শ্রদ্ধা, রাগ, ক্ষোভ, শিশুর সারল্য-- সব মিলিয়ে চরিত্রটি খুব কঠিন। সব্যসাচী এই চরিত্রটিকে দর্শকের অত্যন্ত প্রিয় করে তুলেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, সাধককে বড় রক্তমাংসের মানুষ মনে হয়, যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
জয়ী দেবরায় (হৃদয়হরণ বিএ পাশ, জি বাংলা)
এই ধারাবাহিকটি নিছকই সোশাল ড্রামা কিন্তু চরিত্রটি অসাধারণ। হৃদয়হরণ এমন একটি চরিত্র যাকে সব মেয়েরাই প্রেমিক বা স্বামী হিসেবে পেতে চাইবে। এই ধারাবাহিকে ঘটনার ঘনঘটা এত বেশি ছিল যে হৃদয় চরিত্রটিও নানা ধরনের পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। জয়ীর অভিনয়ের দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলতেই হয়। জয়ী একেবারেই মেথড অভিনেতা নন। তিনি মাথা দিয়ে অভিনয় করেন, অথচ সেখানে প্রয়োজনীয় আবেগ কম পড়ে না। পর্দার অভিনয়ের সূক্ষ্মতাও অত্যন্ত ভালভাবে রপ্ত করেছেন তিনি। এই মুহূর্তে বাংলা টেলিপর্দার সবচেয়ে প্রতিভাময় অভিনেতাদের একজন তিনি। আরও চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে তাঁকে দেখার ইচ্ছা রইল।
শন বন্দ্যোপাধ্যায় (আমি সিরাজের বেগম, স্টার জলসা)
ঐতিহাসিক চরিত্র মানেই তা লার্জার দ্যান লাইফ। আর সিরাজদৌল্লার মতো কোনও চরিত্র যদি হয়, সেখানে অনেক জ্বালাময়ী সংলাপ থাকবে, অনেক হাই-টোন দৃশ্যও থাকবে বলা বাহুল্য। এই ধারাবাহিকটি ছিল শনের ডেবিউ ধারাবাহিক। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের চরিত্রে শন অত্যন্ত মানানসই ছিলেন প্রথমত। দ্বিতীয়ত, তাঁর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর এতটাই জলদগম্ভীর যে সেটা এই চরিত্রের পক্ষে অত্যন্ত উপযোগী হয়েছে। এ দুটি বাদ দিলে, পর্দার অভিনয়ের সূক্ষ্মতার বিষয়টি প্রথম থেকেই মাথায় রেখে অভিনয় করেছেন শন। তাই সেরা তালিকায় তাঁকে রাখতেই হবে।