শুভাশিষ মুখোপাধ্যায়
রবি ঘোষ বাংলা নাট্যজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলা চলচ্চিত্রেরও এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। রবিদার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় দীর্ঘদিনের। একসঙ্গে অনেক কাজ করেছি। কিন্তু, আমার দুর্ভাগ্য মঞ্চে কোনওদিন একসঙ্গে অভিনয় করতে পারিনি। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। আমার প্রথম ধারাবাহিক 'অভিনন্দন ভগিরথ', যা বাংলা ধারাবাহিকের প্রায় প্রথম যুগের সিরিয়াল। সম্ভবত, সেটা ছিল বাংলা সিরিয়াল জগতের দ্বিতীয় ধারাবাহিক। সেখানে আমি একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল রবি দা ও দীপঙ্কর দে। পরিচালক রাজা সেন আমাকে এই সিরিয়ালটিতে কাজ করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সূত্রে রবিদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। এরপর থেকে দীর্ঘ সম্পর্ক। রবি ঘোষ কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন তা আজ আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
তিনি যখন গ্রুপ থিয়েটার করতেন তখন লিটল থিয়েটর গ্রুপের প্রধান ছিলেন উৎপল দত্ত। সেই দলের নাটক দেখার সুযোগ হয়নি। তবে যেটা মনে পড়ে ছোটবেলায় একবার মিনারভা নাট্যগৃহে 'কল্লোল' দেখেছিলাম। কিন্তু, পরবর্তীকালে বা তার আগে লিটল থিয়েটর গ্রুপের কোনও নাটক দেখা হয়নি। কারণ সেগুলো প্রায় জন্মের আগে বা জন্মের পর সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছিল। তবে 'অঙ্গার' বলে মিনারভা নাট্যগৃহে বহুবছর চলেছিল, যেটা লিটল থিয়েটর গ্রুপেরই ছিল। সেখানে রবি দা অসাধারণ একটি চরিত্রে অভিনয় করতেন। পরবর্তীকালে অন্যান্য নাট্যদলে যখন কাজ করেছেন তাঁর অভিনয়ে একটি অন্য ধারার ছাপ রেখে গিয়েছেন।
আমরা জানি সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কোন মাপের অভিনয় করে গিয়েছেন। বাংলা সিনেমায় তাঁকে বাঘা বললে অত্যোক্তি হবে না। আমরা ছোটবেলায় তাঁকে 'বাঘা' বলেই চিনতাম। 'গুপি গায়েন বাঘা বায়েনের' যে অমর সৃষ্টি সেই বাঘা। রবি দার যে একটা চাপা অভিনয়ের স্বভাব ছিল অর্থাৎ তিনি কোনওদিনই কোনওভাবেই উচ্চাখিত (subdued Acting)অভিনয় করতেন না। কোনওদিন সেই মাপের বাইরে গিয়ে অভিনয় করেননি এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যে কোনও চরিত্রকে নির্মাণ করে গিয়েছেন। রবি দা নিজে একটি নাট্যদলের পরিচালক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার কাজের সূত্রে বহুবার দেখা হয়েছে। রবি দার যেটা শেষ কাজ ছিল তার ঠিক দুদিন আগে আমি তাঁর সঙ্গে দূরদর্শনের একটি ধারাবাহিকে কাজ করছিলাম। সেটি শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেনি। কারণ কাজ শেষ করার দুদিন আগেই রবিদা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
ধারাবাহিকের শ্যুটিংয়ের একটা কথা মনে আছে। বাবুঘাটের কাছে শ্যুটিং করে ফিরছিলাম। তখন সামান্য বৃষ্টি হচ্ছিল। ম্যাটাডোরে ফিরছিলাম, রবিদাও বললেন আমি যাব। আমরা বললাম এটাতে যাবেন না। কারণ আকাশে তখন মেঘ করেছে। আরও জোড়ে বৃষ্টি আসবে। তখন বললেন, তোরা যাবি আর আমি যেতে পারব না? যেতে যেতে বৃষ্টি নামল। তখন ত্রিপল, প্লাস্টিক আমরা সবাই মিলে মাথার উপর ধরেছিলাম। রবিদাও বলল, আমিও ধরব। ওইরকমভাবে আমরা গন্তব্যে পৌঁছলাম। রবিদা লাফিয়ে ম্যাটাডোর থেকে নামলেন আর বলে গেলেন, দেখা হচ্ছে পরের দিন। সেই যাওয়াই শেষ যাওয়া। তাই ধারাবাহিকের কাজও আর সম্পন্ন হয়নি। আমার দুর্ভাগ্য, যে এই ধারাবাহিকে জুটি ছিলাম আমরা।
কিন্তু, তা সম্পূর্ণ হল না। রবিদার সঙ্গে আমার দেখা হত ওঁর বাড়িতেই। উনি থাকতেন গল্ফগ্রিনে। যে ফ্ল্যাটে থাকত তার পাশেই ছিল সেই সময়ের প্রখ্যাত পরিচালক দীনেন গুপ্তের ফ্ল্যাট। আমি তখন দীনেন দার ছবি-সিরিয়ালে কাজ করছিলাম। তাই যাতায়াত ছিল। সেই সুবাদে ওঁর সঙ্গে দেখা হত। তবে কোনওদিন ফ্ল্যাটের ভিতর দেখা হত না। নীচেই দেখতাম রবিদাকে। তবে একদিন দেখি ওঁর ফ্ল্যাটের দরজাটা খোলা। সোজাসুজি একটি দেওয়াল। সেখানে একটি সোফায় লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে বসে আছেন এবং রবিদার মাথার উপরে যিনি বিরাজ করছেন তিনি আমাদের কৌতুক জীবনের ভগবান 'কমেডি কিং' 'চার্লি চ্যাপলিন'।
তাঁর পায়ের তলায় রবি ঘোষ বসে আছেন। সে যা দৃশ্য! আমাকে দেখে রবি দা বললেন, কী রে ভাল আছিস? আমি বললাম তুমি ভাল আছ? বলল, কোথায় যাচ্ছিস, খোকার (দীনেন গুপ্ত) কাছে? মাঝে মাঝে যখন রবিদার দরজা খোলা দেখতাম তখনই তিনি চার্লি চ্যাপলিনের পদতলে বসে আছে। রবিদা কমেডি করত বলে কিন্তু, এটা নয় যে সারাক্ষণ কমেডিই করে যাচ্ছে। একেবারেই নয়। আমার মনে আছে, একবার NT1 স্টুডিও থেকে তাঁর ব্যাগটি চুরি হয়ে যায়। সেদিনও তিনি উত্তেজিত হযনি বা রেগে যায়নি।
একবার রাগতে দেখেছিলাম। তখন চলচ্চিত্রের পার্শ্বচরিত্রগুলো করতাম। কখনও আবার দলের কনিষ্ঠ ভিলেন বা মেইন ভিলেনের সাগরেদ। নর্থ বেঙ্গলে শ্যুটিং করতে গিয়েছি। সেখানে ভিলেনের দল পাহাড়ের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। রবি ঘোষ পুলিশের বড়বাবুর চরিত্রে অভিনয় করছিলেন। পুলিশের ব্যান তাড়া করেছে আমাদের। বোমা মারতে মারতে এগচ্ছি। শট নেওয়া হবে উপর থেকে যেখানে রবি দার জিপটা এসে পাহাড়ে উঠছে। পরিচালক রবিদাকে বললেন, তুমি জিপে বসবে। রবিদা বলল ক্যামেরা কোথায়?পরিচালক বললেন, ওই তো উপরে। পাহাড়ের উপরে ক্যামেরা ফিট করা আছে। রবিদা বলল, ওখান থেকে আমাকে কী দেখবে?
তবে পরিচালক বোঝানোর পর রবিদা রাজি হল। তখন যে পদ্ধতিতে বোমা ফাটানো হত সেগুলো যখন ফাটত তখন মাটিগুলো এমনভাবে উড়ত যা ধোঁয়ার সৃষ্টি করত। শট শুরু হল। গাড়ির সামনে যেমন বোমা ফাটার কথাছিল সেটা হল। গাড়ির ভিতর রবিদাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই চিন্তিত। হঠাৎ দেখি একটা ভূত গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। সারা শরীর মাটিতে মাখামাখি। মাথায় টুপি আর চোখটা দেখা যাচ্ছে। ভূতের মতো তাকিয়ে আছে, প্রচণ্ড রেগে আছে। পরিচালককে সামনে আসতেই রবিদা বলল, আমি বারণ করলাম গাড়িতে বসিও না। এটা কী হল! ওই অবস্থায় সোজা হোটেলে চলে গেল।
রবিদার সঙ্গে কাটানো এই সময়গুলোর কথাই বারবার মনে পড়ে। আশুতোষ কলেজের মঞ্চে ছদ্মবেশি নাটকটা করছে। সেই সময় কলকাতার এক নামী সংবাদপত্র থেকে ওই নাটকের সমালোচনা করতে বলা হল। আমি প্রথমেই না করে দিলাম, কারণ আমার পক্ষে এটা সম্ভবই ছিল না। তবুও আমাকে রাজি করানো হল। অগত্যা রবিদার নাটক দেখতে গেলাম। দেখার পর আমার যা যা মনে হল সেটা লিখেছি। আমার চোখে যে দু-একটি ভুল ধরা পড়েছিল সেটারও উল্লেখ করেছিলাম। রিভিউটি বেরনোর পর যখন রবিদার সঙ্গে দেখা হত পালিয়ে যেতাম। কিন্তু, কোনওদিন ওই রিভিউ নিয়ে কথা বলেননি। এইরকম মানুষ ছিলেন রবিদা। আজ থাকলে অনেক পরামর্শ পেতাম।
NT1 স্টুডিও-তে কাজ করছিলাম দুজনে। মেকআপ করছিলাম। স্টুডিওর ১০ নম্বর রুমে সিনিয়ররা বসতেন। সৌভাগ্যক্রমে আমিও সেখানে জায়গা পেয়েছিলাম। লাঞ্চের পর একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব হয়েছিল। পাশে একটা সোফা ছিল। সেখানে একটু শুয়ে পরি। আরেকটা সোফায় রবিদা বসেছিল। আমাকে যখন শটের জন্য সহকারী পরিচালক ডাকতে এলেন তখন তো আমি ঘুমের মধ্যে। রবিদা বলল তাড়াতাড়ি ওঠ, শট রেডি। তড়িঘড়ি করে উঠে চোখে জল দিয়ে শটের জন্য গেলাম। রবিদা তখন বলল, শোন যেটা করছিলি একদম ঠিক কাজ। আমাদের শরীরে ঘুমটা ভীষণ প্রয়োজন। যে যা বলে বলুক সুযোগ পেলে ঘুমিয়ে নিবি। এই ধরনের সাপোর্ট ক'জন করে! আমি কিন্তু, তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত খাবারের পর একটু ঘুমিয়ে নিই।