সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে সুদীপ্তা চক্রবর্তী ও মীর আফসর আলির একটি ছবি। দুজনেই সংবাদপাঠরত 'খাস খবর'-এর জন্য। যাঁরা নব্বই দশকে বড় হয়েছেন তাঁরা জানেন দূরদর্শন-এ সম্প্রচারিত এই বেসরকারি নিউজ বুলেটিনটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল নব্বইয়ের শেষের দিকে। প্রথমত 'খাস খবর' ছিল বাংলায় প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে নিউজ পরিবেশন। দ্বিতীয়ত, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বাংলার দর্শকের কাছে সংবাদ পরিবেশনে এক নতুন মডেল-এর সূচনা করে 'খাস খবর'। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে সুদীপ্তা চক্রবর্তী জানালেন তাঁর 'খাস খবর' পর্যায়ের নানা স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার কথা।
''খাস খবর' নিয়ে অজস্র স্মৃতি রয়েছে। কথা শুরু করলে আর শেষ হবে না। অভিনয় করে আমি যতটা না জনপ্রিয় হয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা দিয়েছিল আমাকে 'খাস খবর'', বলেন সুদীপ্তা, ''আমাদের তিন বোনকে (বিদীপ্তা, বিদিশা, সুদীপ্তা) ডেকে পাঠিয়েছিলেন পরিচালক সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়। 'খাস খবর'-এর জন্য তখন অডিশন চলছে। উনি বলেছিলেন যে স্মার্ট অথচ ভাল বাংলা বলতে পারে এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। যারা স্মার্ট হয় তারা বাংলাটা বলতেই পারে না আর যারা বাংলা বলতে পারছে তারা হয় আবৃত্তির মতো করে খবর পড়ছে নয়তো একেবারেই ঠিক নিউজ অ্যাঙ্কর হওয়ার মতো স্মার্টনেস নেই। তাই আমাদের তিন বোনের ডাক পড়েছিল আর আমরা তিনজনেই সিলেক্টেড হই। তার পরে প্রায় দুমাস আমরা দশ-বারো জন একসঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছিলাম।''
আরও পড়ুন: ‘অনলাইন রিলিজে সিনেমা হলের ম্যাজিক কই!’
আশির দশকে যখন কলকাতা দূরদর্শন তার যাত্রা শুরু করে তখন সংবাদপাঠক বা পাঠিকাদের দেখা যেত খবর পড়তে। জাতীয় স্তরেও আশির দশকের শুরুতে সংবাদ শুধুই পাঠ করার বিষয় ছিল। প্রণয় রায়-এর 'দ্য নিউজ টুনাইট' ও 'ওয়ার্ল্ড দিস উইক' খবরকে শুধুমাত্র পাঠ থেকে বার করে নিয়ে এসেছিল। সেই প্রথম অডিও ভিস্যুয়াল নিউজ বুলেটিনে নিউজ অ্যাঙ্করের উপস্থাপনা ও ফিল্ড রিপোর্টিংকে জুড়ে দেওয়া হল। যে ঘটনা বা যে জায়গা নিয়ে খবর, দর্শক সেই জায়গাটা দেখতে পেলেন। সেখানকার মানুষের কথা তাঁদের মুখেই শুনতে পেলেন।
বাংলায় ঠিক সেই কাজটিই শুরু করেছিল 'খাস খবর' প্রায় ১০ বছর পরে। প্রথমে অভিজিৎ দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় এই বুলেটিন। পরে দায়িত্ব নিয়েছিলেন দিব্যজ্যোতি বোস। দূরদর্শন-এর দুটি স্লটে প্রথমে 'খাস খবর' শুরু হয়। পরে সেটি ৩টি স্লটে দাঁড়ায়। প্রথম দিনের প্রথম নিউজ বুলেটিনটি পড়েছিলেন সুদীপ্তা চক্রবর্তী ও কৌশিক ভট্টাচার্য। ''খাস খবর'-এর প্রথম সম্প্রচার হয় ৯৮ সালের ৫ অক্টোবর। তার জন্য ৪ অক্টোবর সারা রাত ধরে শুট করা হয়েছিল। আমার খুব গর্ব হয় যে বাংলায় বেসরকারি নিউজ বুলেটিনের প্রথম অ্যাঙ্কর ছিলাম আমি আর কৌশিক। তার আগে পর্যন্ত কিন্তু শুধুমাত্র দূরদর্শন-এর সংবাদ পাঠক-পাঠিকারাই খবর পড়তেন। 'খাস খবর' লাইভ নিউজ ছিল না। সম্প্রচারের যা সময় তার দু-আড়াই ঘণ্টা আগে আমাদের নিউজটা পড়তে হতো। সেই রেকর্ডিংয়ের সঙ্গে ফুটেজ যোগ করা হতো। পুরো প্যাকেজটা এডিট করে পাঠানো হতো দূরদর্শন কেন্দ্রের অফিসে'', জানান সুদীপ্তা। প্রথমদিকে অভিজিৎ দাশগুপ্তের বাড়ির স্টুডিওতে শুট করা হতো, পরে 'নবীনা' সিনেমা হলের উপরে 'রেনবো'-র নিজস্ব অফিসে।
আরও পড়ুন: ‘পাতাল লোক’ প্রমাণ করেছে কনটেন্টই শেষ কথা: অনুষ্কা
অভিনেত্রী জানালেন 'খাস খবর' শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেই নিউজ অ্যাঙ্কর হিসেবে কাজ শুরু করেন মীর। যে ছবিটি সোশাল মিডিয়ায় সম্প্রতি দেখা গিয়েছে সেটি আসলে একটি বুলেটিনের ভিডিও থেকে নেওয়া স্ক্রিনগ্র্যাব। 'খাস খবর'-এর বেশ কিছু বুলেটিন এখনও রয়েছে ইউটিউবে। গুণমুগ্ধরা সেখান থেকেই সুদীপ্তা চক্রবর্তী ও মীর-এর স্ক্রিনগ্র্যাব সংগ্রহ করেছেন। এই নস্টালজিয়া-সমৃদ্ধ ছবিটি সোশাল মিডিয়ায় তুমুল সাড়া ফেলেছে। সুদীপ্তা বলেন, ''আমি সেদিন সকাল থেকে হোয়াটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জারে কতজনের থেকে যে ছবিটা পেয়েছি। 'অলি গলি টলিউড' গ্রুপ থেকেই এটা প্রথম পোস্ট করা হয়, ছবিতে ওই গ্রুপ-এর লোগোও রয়েছে।''
খুব কম সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল 'খাস খবর'। ওই বুলেটিনের নিউজ অ্যাঙ্করদের খ্যাতি ছিল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতো। সুদীপ্তা জানালেন প্রচুর ক্লাবের অনুষ্ঠান, পুজোর উদ্বোধনে ডাক আসত। সেই সময়ে অগুনতি শো হোস্ট করেছেন তিনি যেগুলি মূলত এসেছিল 'খাস খবর'-এর জনপ্রিয়তার কারণেই। এই সংক্রান্ত দুটি মজার ঘটনা জানালেন তিনি। ''আমার মা মলমলে ব্লক প্রিন্ট শাড়ি পরতে খুব ভালবাসেন। তখন আর আমাদের শাড়ি কোথায়। মায়ের আলমারি থেকেই শাড়ি নিয়ে পরতাম। সেটাই যে কখন ট্রেন্ড হয়ে গেছে জানতে পারিনি। বাবা একদিন বাড়ি ফিরে বলল অফিসের একজন কলিগ বাবাকে বলেছেন, 'আপনার মেয়ে কী শাড়ি পরে খবর পড়ে, আমার স্ত্রী পাগল হয়ে যাচ্ছে ওই শাড়ি কিনে দেওয়ার জন্য।' ওঁর স্ত্রী নাকি বেহালা বাজারে দেখেছিলেন এরকম শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। যিনি বিক্রি করছেন তিনি চিৎকার করে বলছেন, 'খাস খবর' শাড়ি, সুদীপ্তা পরে, আপনিও পরুন।' মানে ওই ব্লক প্রিন্টের মলমল শাড়ির নাম হয়ে গেল 'খাস খবর' শাড়ি। ময়দান, নিউ মার্কেট, হাতিবাগান-এ 'খাস খবর' শাড়ি তখন রমরম করে বিক্রি হতো। পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি, দেখছি এক জায়গায় লাইটিং হয়েছে-- আমি আর কৌশিক খবর পড়ছি। আমাদের অ্যাঙ্করদের আদলে ঠাকুর তৈরি হয়েছে। কোথায় একটা মনে নেই আমার আর মীরের আদলে রাধাকৃষ্ণ মূর্তি বানিয়ে দোল খেলা হয়েছিল'', হাসতে হাসতে জানালেন সুদীপ্তা।
আরও পড়ুন: গুলাবো সিতাবো রিভিউ: হাসিটা যেন বড় মাঝারি মানের
এই জনপ্রিয়তার আবার অন্য দিকও ছিল। ওই সময় অনেক অভিনয়ের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে, অনেকে তাঁকে কাস্টিং করতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছেন কারণ এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে সুদীপ্তা চক্রবর্তী রেনবো-তে চাকরি করছেন তাই অভিনয়ে সময় দিতে পারবেন না। কিন্তু সুযোগ্য অভিনেত্রীকে আটকে রাখা যায় না। 'বাড়িওয়ালি'-তে তাঁর কাস্টিংয়ে একটা বড় অবদান রয়েছে 'খাস খবর'-এর। ''আমাকে ঋতুদা (ঋতুপর্ণ ঘোষ) অনেকদিন ধরেই খুঁজছিলেন কিন্তু নাম মনে ছিল না। পরিচিত অনেককেই বর্ণনা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারেলনি। শেষমেশ 'খাস খবর'-এ আমাকে দেখে মন্টুদা (সুমন্ত মুখোপাধ্যায়) ও মিলন রায়চৌধুরীকে বলেন যে এই মেয়েটিকেই আমি খুঁজছি। 'বাড়িওয়ালি'-তে কাজ করার পরে মীর আমাকে অনুরোধ করে ঋতুদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য। রেনবো অফিসের কাছেই ঋতুদার বাড়ি। একদিন মর্নিং বুলেটিন পড়ে আমরা দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেটা ছিল একটা মেমোরেবল মর্নিং।''
একটা সময় পরে এই কাজটি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন সুদীপ্তা কারণ অভিনেত্রী হওয়ার লক্ষ্যই ছিল তাঁর কিন্তু ওই সময়টা তাঁর কাছে অত্যন্ত মূল্যবান একটি সময়। ''খাস খবর' ছিল বাংলা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে খবর পরিবেশনের একটি প্যারাডাইম শিফট। 'খাস খবর'-এর বহু রিপোর্টার এখন এক একটি বাংলা নিউজ চ্যানেলের হেড। কেউ কেউ ফিল্মমেকার হয়ে গিয়েছেন। কেউ কলকাতার বাইরে অন্য শহরে খুব ভাল কাজ করছেন। নিঃসন্দেহে বাংলা সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় রয়েছে 'খাস খবর'-এর। সেই ইতিহাসের অংশ হতে পেরে আজীবন গর্বিত'', বলেন সুদীপ্তা।