প্রশ্ন: চালচিত্রের সাফল্যকে সঙ্গী করেই নতুন বছর সেলিব্রেশন...?
তানিকা: (ফোনের ওপারে মিষ্টি হাসি)...: ছবির সাকসেসে তো অবশ্যই ভীষণ খুশি। সেটাও নতুন বছরের বিরাট প্রাপ্তি। বন্ধুদের সঙ্গে ৩১ তারিখ রাতে পার্টি করেছি। পরদিন বিধাননগর মেলায় ঘুরতে গিয়েছি। ওখানে গিয়ে কোনও রাইড চড়িনি। তবে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করেছি। চাট, আইসক্রিম সব খেয়েছি। খুব মজা করেই কেটেছে নতুন বছর।
প্রশ্ন: মেলায় কেউ পুতুল বলে ডাক দিল?
তানিকা: (খানিক হেসে)...না না, মেলায় কেউ পুতুল বলে ডাকেনি। আসলে আমাকে দেখলে কেউ চলজলদি বুঝতে পারবে না যে আমিই সেই পুতুল। আমরা যখন হল ভিজিট করতে যাচ্ছিলাম তখন প্রতিম দা মাইকে ঘোষণা করে দিচ্ছিলেন আমাদের সঙ্গে পুতুলও আছে। তখন দর্শক আমাকে দেখে বুঝতে পারছে যে এতক্ষণ যাকে সিনেমায় দেখলাম এই সেই মেয়ে। আমার নাকি 'বেবি ফেস' তাই বয়সের তুলনায় অল্পবয়সীর চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগটা বেশি আসে।
প্রশ্ন: এটা মনের কোনও আক্ষেপ না পজিটিভ দিক হিসেবে দেখেন?
তানিকা: সব কিঠুরই তো ভাল-মন্দ দুটি দিক আছে। আবার বছর কুড়ি পরে-তে তনুশ্রীদির ছোটবেলাটা করেছিলাম। এইরকম আরও কিছু কাজ করেছি যেখানে আমার মুখের আদল একটু অল্পবয়সী মেয়ের চরিত্রের সঙ্গে মেলে। অবশ্যই এটা প্লাস পয়েন্ট। আবার মনে হয়, একটু পরিণত চরিত্রেও তো কাজ করতে হবে।
প্রশ্ন: পুতুলের চরিত্রে অডিশনের প্রস্তাব পাওয়ার পরই রাজি হয়েছিলেন নাকি এই ধরনের চরিত্রের জন্য ভাবতে হয়েছে?
তানিকা: আমার কাছে যখন অডিশন দেওয়ার সুযোগ এসেছে আমি জানতে চেয়েছি চরিত্রটা কতক্ষণের, প্রাইমারি চরিত্র কিনা, আর কারা আছেন, এডিটের সময় বাদ যাবে কিনা। অনেক সময় ছোট চরিত্রগুলো বিশেষ প্রাধান্য পায় না। বাদও চলে যায়। সেই জন্য আমি প্রথমে রাজি হইনি। আমি অডিশন দেব না শুনে প্রতিম দা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন এটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আর ভীষণ কঠিন। আমাকে চরিত্রটা সম্পর্কে ডিটেইলে কিছু বলেননি প্রতিম দা। চালচিত্রের গল্পটা পুরো জানতেন টোটা দা আর দু-একজন। আসলে প্রতিম দা থ্রিলার ছবির গল্প আগে থেকে কাউকে বলেন না। এটা ওঁর স্টাইল।
প্রশ্ন: ফাইনালি পুতুলের জন্য রাজি হলেন...
তানিকা: আমাকে অডিশনের জন্য যখন সিনগুলো পাঠানো হল তখন বিষয়টার গুরুত্ব বুঝলাম। যদি দু-একটা সিন বাদও যায় তাহলেও চরিত্রটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকদিন আগে আমি একটা শর্টফিল্মে এই ধরনের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। সেটা দর্শকের কাছে সেভাবে পৌঁছায় নি। ওটিটি-তে রিলিজ করেছিল। আমি নিজেও অনেকটা ছোট। তাই ভাবলাম অডিশন তো দিই। অডিশন দিতে গিয়ে খুব ভাল লাগল। ১০-১২ দিন পর সিলেক্ট হলাম। তখনও আমি জানতাম না পুতুলের জন্য অনেকেই অডিশন দিয়েছে। কোনও না কোনও কারণে তাঁরা সিলেক্ট হননি।
প্রশ্ন: অডিশনের জন্য কোনও বিশেষ প্রস্তুতি?
তানিকা: আমি অনেকটা পরে অডিশন দিয়েছি। নিজের মতো করে রিসার্চ করে অডিশনে গিয়েছিলাম। এখন মনে হয় এই চরিত্রটা আমার কাছে ভগবানের আশীর্বাদ।
প্রশ্ন: পুতুল চরিত্রটার জন্য নিজেকে নিজের কতটা সময় দিতে হয়েছে?
তানিকা: গুগল মিটে প্রতিম দার সঙ্গে দুটো ওয়ার্কশপ করেছিলাম। আমাকে বেশ কিছু মেটিরিয়াল সাজেস্ট করেছিলেন দেখার জন্য। আমি নিজেও ইউটিউব দেখতাম। বেণী দামিনী বসুর কাছে আমি অভিনয়ের ট্রেনিং নিই। উনি আমার কোচ। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ফোনেই আমাকে টিপস দেন। আয়নার সামনে দাড়িয়ে ফোনে রেকর্ড করে প্রতিম দাকে দেখাতাম। নিজের থেকেও অনেক কিছু এক্সপিরিমেন্ট করেছি। প্রতিমদার যদি সেটা ভাল লাগত আমাকে করতে দিতেন। এভাবেই কাজটা হয়ে গেল। দর্শকের ভালবাসা পাচ্ছি। (ফোনের ওপারে মৃদু হাসি)
প্রশ্ন: একটানা হুইল চেয়ারে বসে শ্যুটিং করা কতটা চ্যালেঞ্জিং?
তানিকা: আমার রোজ একটানা শ্যুটিং ছিল না। চার-পাঁচদিনের শ্যুটিং করেছি। তবে হুইলচেয়ারে বসে যে মুভমেন্টগুলো করতাম সেটা সত্যিই কঠিন ছিল। প্রথমদিন শ্যুটিংয়ের পর খেয়াল করি হাতের বিভিন্ন জায়গায় চেয়ারের হ্যান্ডেলের জন্য কালসিটে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু, সেই জন্য আমার কোনও আপশোস নেই। বরং মনে হচ্ছিল একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হচ্ছে। চোখের টেকনিক্যালি কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হত। সেটায় একটু কষ্ট হলেও তার মধ্যে আনন্দটাই বেশি ছিল। এই রকম চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগও তো সবসময় আসে না।
প্রশ্ন: বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রে এর আগে অপরাজিতা আঢ্য, প্রীতি বিশ্বাস বাংলা ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন...
তানিকা: (সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিয়ে) হ্যাঁ, আমি জল নুপূরে অপাদির অভিনয় দেখেছি। আমি কারও সঙ্গে তুলনায় যেতে চাই না। সিরিয়াল আর সিনেমার কাজের ক্ষেত্রে একটা বিস্তর ফারাক আছে। পুতুলের চরিত্রে আমাকে দেখে একজন দর্শক বলেছেন, তোমাকে দেখে আমার পারমিতার একদিনের সোহিনী সেনগুপ্তর কথা মনে পড়ে গেল। উনিও কিন্তু, তুলনা করেননি। তবে আমাকে দেখে সোহিনী সেনগুপ্তের মতো একজন আর্টিস্টের কথা কারও মনে পড়াটা আমার কাছে নিঃসন্দেহে কমপ্লিমেন্ট।
প্রশ্ন: চালচিত্রর পর জনপ্রিয়তা একলাফে কয়েক ধাপ বেড়ে গেল। এরপর চরিত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোন দিকগুলো খেয়াল রাখবেন?
তানিকা: আমি একজন স্ট্রাগলিং অ্যাক্টর। আমার কাছে এখনও পর্যন্ত বড় অফার আসে না, অডিশনের প্রস্তাব আসে। আমি কোনও কাজ করার সময় একটা বিষয় মাথায় রাখি গল্পটাকে আমার চরিত্র কতটা প্রভাবিত করছে। ওই চরিত্রটা করে আমি ব্যক্তিগতভাবে মজা পাব কিনা সেটা আগে দেখি। সেই জন্য আমি অনেক প্রস্তাব নাকচ করতে বাধ্য হয়েছি। ভবিষ্যতেও এই বিষয়গুলোই খেয়াল রাখব।
প্রশ্ন: চালচিত্রে পুতুলের চরিত্রে অভিনয়ের পর কেরিয়ারে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল?
তানিকা: আমার বন্ধুবান্ধব, কাছের মানুষরা তো অনেকেই বলছেন এবার তো তুই একের পর এক কাজ পাবি। এই হবে..সেই হবে...(জোরে হাসি)। কিন্তু, আমার বাড়ির বাইরে তো লাইন পড়েনি। আর এখনও পর্যন্ত নতুন কাজের কোনও প্রস্তাবও আসেনি। আসলে কাছের মানুষরা এগুলো ভাবতে ভালবাসে। আমার কোনও ক্ষোভ নেই যে কেন অনেক কাজের সুযোগ আসছে না। আমার মতে, বাণিজ্যিক সাফল্যের নিরিখে যারা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বাছাই করেন তাঁরা অভিনয় দেখে করেন না (হয়ত অনেক বড় কথা বলে ফেললাম)।
প্রশ্ন: চালচিত্র ২-তে পুতুল-র চরিত্রে তাহলে আবার দর্শক তানিকা বসুকে দেখছে...
তানিকা: চালচিত্র ২ তো পুতুল ছাড়া হবেই না। দর্শকের যা ফিডব্যাক আর গল্প যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে পুতুল অপরিহার্য। আর পুতুলের মতো একটা চরিত্রে সুযোগ পেলে হাতছাড়া করা যায় নাকি?
প্রশ্ন: অপূর্ব তো এপার-ওপার দুই বাংলার ক্রাশ, কাজ করে অভিজ্ঞতা কেমন?
তানিকা: দুঃখের কথা আর কী বলব (হাসি)। অপূর্বর সঙ্গে তো কোনও সিন ছিল না। এমনকী শ্যুটিং লোকেশনেও দেখা হয়নি। আমার ছিল ইন্ডোর। আর ওঁর আউটডোরের বিভিন্ন জায়গায়। তবে শান্তনুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। সেটার জন্য হ্যাপি। তবে অপূর্ব, রাইমা দি, শান্তনুকে প্রমোশনে ওদেরকে মিস করেছি।
প্রশ্ন: অনেক সিনিয়র স্টারদের সঙ্গে কাজের সুযোগ হল। নতুন কী শিখতে পারলেন?
তানিকা: প্রত্যেকটা কাজ থেকে প্রতি মুহূর্তে কিছু না কিছু শিখতে পারি আমরা। টোটা দার মতো একজন অভিনেতা এত ডাউন টু আর্থ জাস্ট ভাবা যায় না। সবসময় ফ্লোরে থাকতেন। রাইমাদি-কে তো দেখেই মনে হয় উনি একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। হাত নাড়ার স্টাইল থেকে কথা বলার ধরন সত্যিই শেখার মতো। এত বড় মাপের মানুষগুলোর মধ্যে কোনও ইগো নেই। এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়। হল ভিজিট আর প্রমোশনের সময় টোটাদার শব্দ চয়নটাও শেখার মতো। আমি অনির্বাণদার ফ্যান। তাই পর্দাতেও কেমেস্ট্রিটা দারুণ জমেছে। একটা জিনিস আমি দেখেছি, উনি যতই ক্লান্ত থাক কো-স্টার যদি সেই সময় কিছু বলে সঙ্গে সঙ্গে রেসপন্স করেন। আগে একটা কাজ করেছি অনির্বাণদার সঙ্গে সেটা অনেকেই হয়ত জানে না।
প্রশ্ন: কী সেটা?
তানিকা: অপর্ণা সেনের ঘরে বাইরে ছবিতে আমি আর অনির্বাণদা পরিচারক-পরিচারিকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। সেই হিসেব মতো এটা আমাদের দ্বিতীয় কাজ।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রির কোন নায়কের বিপরীতে কাজ করার ইচ্ছে?
তানিকা: উফ! সে তো লম্বা লিস্ট। অনেকের সঙ্গেই কাজ করতে চাই। তবে প্রথমেই যার নাম বলব তিনি ঋত্বিক চক্রবর্তী। কেন যে সুযোগটা পাচ্ছি না! কবে থেকে এটা আমার স্বপ্ন। ওঁর বিপরীতে কাজের সুযোগ না পাই, অন্তত উনি আছেন এমন একটা ছবিতেও যদি সুযোগ পেতাম। যীশুদার প্রোডাকশনেই আমার হাতখড়ি। যদি কাজের সুযোগ আসে মন্দ কী। পরাণ জ্যেঠু, শাশ্বত দা, অঞ্জন দার সঙ্গে কাজ করতে চাই। অঞ্জনদার নির্দেশনায় কাজ করেছি। কিন্তু, আমি ওঁর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করতে চাই। অপর্ণা সেন, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ও আমার পছন্দের তালিকায় আছেন। আরও অনেকে আছেন। আমার সমসাময়িক অভিনেতারা তো আছেই।
প্রশ্ন: পুতুলের পর এবার এবার তানিকা বসুর কাছে এই ধরনের চরিত্রের প্রস্তাবই বেশি আসবে?
তানিকা: টাইপ কাস্টের একটা ব্যাপারটা কিন্তু বহু পুরনো বিষয়। আমি এখনও পর্যন্ত ভিন্ন স্বাদের চরিত্রে অভিনয় করেছি। এখন একটা সিরিজে কাজ করছি। সেটাও একদম অন্যরকম। ইন্দু, বিজয়ার পরে, আবার বছর কুড়ি পরে-র মতো অনেক সিনেমা সিরিজে আমার কাজের সঙ্গে কিন্তু, দর্শক পুতুলের মিল পায়নি। দর্শক কিন্তু, ভাল কাজ দেখতে চায়। আর আমার মনে হয় ক্রিয়েটিভ মানুষরা অন্যরকমভাবে ভাবতে বেশি পছন্দ করেন। পরিচালক-প্রযোজকদের থেকে ভবিষ্যতে আরও ভাল অন্যরকম কাজের সুযোগ পাব বলেই আশাবাদী।
প্রশ্ন: পুতুল চরিত্রটা দেখে বাবা-মা, কাছের মানুষরা কী বলেছেন?
তানিকা: মা আমার সঙ্গে প্রিমিয়ারে গিয়েছিলেন। আমাকে সকলে ভালবাসছে দেখে মা একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন। আমাকে কখনই মা সব কাজ দেখে বাহবা দেননি। যেটা মায়ের মনে হয় আরও একটু ভাল করা যেত, অন্য রকম কিছু করা যেত সেটা বলেন। কিন্তু, চালচিত্র দেখে মা বলেছেন, আমি জানি তুই পারিস কিন্তু, এটাও পারবি বুঝিনি। বাবা এখনও দেখেননি। মায়ের ফিডব্যাকটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি মায়ের সঙ্গে থাকি। বাবার সঙ্গে যোগাযোগটা একটু কম। আশা করি বাবাও দেখে আমাকে জানাবেন। বেণী এখনও দেখেননি। ওঁর মতটা জানার জন্যও আমি অপেক্ষা করে আছি।