Krishnakoli Serial: বিগত ৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে একটি ধারাবাহিক ভিউয়ারশিপে ছাপিয়ে গিয়েছে বাকি সব ধারাবাহিককে। এমনকী দুবছর আগে যে ধারাবাহিকটি বাংলা টেলিজগতে নতুন ট্রেন্ডের সূচনা করেছিল, সেই 'করুণাময়ী রাণী রাসমণি'-কেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছনে ফেলে দিয়েছে 'কৃষ্ণকলি'। শুধু তাই নয়, একটি-দুটি সপ্তাহ ছাড়া নিকটতম ধারাবাহিকগুলি থেকে রেটিংয়ে গড়ে ১.৫ সংখ্যায় এগিয়ে থেকেছে।
কিন্তু 'কৃষ্ণকলি' কোনওভাবেই বাংলা টেলিজগতের কাল্ট ধারাবাহিক নয়। পারিবারিক সমীকরণের গল্পে সে কখনওই 'এক আকাশের নীচে'-কে স্পর্শ করতে পারবে না। আবার যদি একটি মেয়ের জীবনসংগ্রামকে ধরা হয়, তবে সমসাময়িক প্রায় সব ধারাবাহিকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ই তাই। সেই দিক থেকেও 'কৃষ্ণকলি' দর্শককে খুব নতুন কিছু দেয় না। বরং 'ইরাবতীর চুপকথা' অথবা 'অন্দরমহল'-এ কেন্দ্রীয় চরিত্রের ক্রাইসিস অনেক বেশি ঘনীভূত।
আরও পড়ুন: 'সাঁঝের বাতি' টেলি রিভিউ: চেনা ছকের গল্পে প্রাপ্তি নিষ্পাপ প্রেম ও নায়ক-নায়িকার রসায়ন
তার পরেও এই মুহূর্তে বা গত এক বছরে নির্দ্বিধায় 'কৃষ্ণকলি'-ই সবচেয়ে সফল ধারাবাহিক। বাণিজ্যিকভাবে সফল। অনুগত ভিউয়ারশিপ তৈরিতে সফল। আর এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে কয়েকটি বিশেষ কারণ। প্রধান কারণ অবশ্যই গ্রামের কালো মেয়ের সঙ্গে শহরের সুপুরুষ ছেলের বিয়ে। তা বাদে আরও ৩টি স্ট্র্যাটেজি মোক্ষম কাজ দিয়েছে--
১. 'কৃষ্ণকলি'-কে রাখা হয়েছে সন্ধ্যা ৭টার স্লটে। বিগত ১০ বছর ধরেই সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার স্লটগুলি জাতীয় এবং আঞ্চলিক টেলিভিশনে গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ বদলেছে। স্টার প্লাসের ধারাবাহিক 'সাথ নিভানা সাথিয়া' এই ট্রেন্ডের সূচনা করেছিল। একসময়ে রাত ৯টা থেকে ১০টাকেই টেলিভিশনের প্রাইমটাইম বলে ধরা হতো। ৭টার স্লটের ওই ধারাবাহিক (সাথ নিভানা সাথিয়া)-এর হাই রেটিং ৯টা থেকে ১০টা টেলিভিশনের প্রাইমটাইমের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। তার পর থেকেই মূলত সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার স্লটগুলি ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলা টেলিভিশনের ক্ষেত্রে গত দুবছরে ভিউয়ারশিপ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৯টার স্লটে। 'কুসুমদোলা', 'ইচ্ছেনদী', 'কে আপন কে পর' থেকে শুরু করে 'করুণাময়ী রাণী রাসমণি', সাম্প্রতিক সময়ের এই সব কটি হিট ধারাবাহিকই কিন্তু ৬টা থেকে ৮টার স্লটের মধ্যেই থেকেছে। তাই সন্ধ্যা ৭টার স্লটের একটি অনুগত ভিউয়ারশিপ পেয়েছে 'কৃষ্ণকলি'।
২. এই ধারাবাহিকের সাফল্যের পিছনে 'করুণাময়ী রাণী রাসমণি'-র একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। এটাকে বলা যায় ভিউয়ারশিপ রিপল এফেক্ট। কোনও বিশেষ স্লটে যদি কোনও ধারাবাহিক খুব জনপ্রিয় হয়ে থাকে, তবে ওই স্লটের আগের এবং পরের স্লটের ধারাবাহিকের রেটিংয়ে তার কিছু না কিছু প্রভাব থাকে। 'কৃষ্ণকলি'-র যখন সম্প্রচার শুরু হয়, তখন করুণাময়ী রাণী রাসমণি প্রায় অপ্রতিরোধ্য ছিল। কিছুদিন 'জয়ী' এবং 'বকুলকথা' টিআরপি-টপার হলেও 'কৃষ্ণকলি' বা 'রাসমণি'-র মতো টানা এত দীর্ঘ সময় ধরে সর্বোচ্চ স্থানে থাকেনি। সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় যে বিপুল সংখ্যক দর্শক নিয়মিত 'রাণী রাসমণি' দেখতেন, তাঁদেরই একটা বড় অংশ ওই রিপল এফেক্টের কারণেই সন্ধ্যা ৭টার স্লটের 'কৃষ্ণকলি'-কে অভ্যাসে পরিণত করেছেন। 'কৃষ্ণকলি'-র এই স্ট্র্যাটেজিক পজিশনিং ধারাবাহিকের বিপুল ভিউয়ারশিপের একটি বড় কারণ। বলা যেতে পারে, 'কৃষ্ণকলি' একা জেতেনি। জিতেছে 'কৃষ্ণকলি' ও 'রাণী রাসমণি'-র যুগলবন্দী। তবে শুধু পজিশনিং দিয়েই সাফল্য আসে না। তার সঙ্গে কনটেন্টও দর্শকের পছন্দের হতে হবে। কৃষ্ণকলি-র ক্ষেত্রে এই দুটি ব্যাপারই কাজ করেছে। বলা যায়, এই পজিশনিং এবং কনটেন্ট পরিপূরক হিসেবে কাজ করে ধারাবাহিককে সাফল্যের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: রেটিং বাড়ছে ‘শ্রীময়ী’-র তবু ধরাছোঁয়ার বাইরে ‘কৃষ্ণকলি’, রইল সাপ্তাহিক সেরা দশ তালিকা
৩. পুরুষতান্ত্রিক পারিবারিক কাঠামোকে বিন্দুমাত্র চ্যালেঞ্জ করে না 'কৃষ্ণকলি' আর সেটাই এত বিপুল জনপ্রিয়তার মূল কারণ। বাংলা টেলিভিশনের দর্শক খুবই রক্ষণশীল। 'কুসুমদোলা', 'আমার দুর্গা', 'অন্দরমহল' থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক 'শ্রীময়ী'-- প্রত্যেকটি ধারাবাহিকেই কেন্দ্রীয় চরিত্র কোনও না কোনও সময়ে প্রতিবাদী হয়েছে। কুসুমদোলা ছাড়া বাকি কোনও ধারাবাহিকই কিন্তু সেভাবে টিআরপি টপার থাকেনি। অর্থাৎ প্রতিবাদী কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রকে দর্শক পছন্দ করেন কিন্তু 'খুব' পছন্দ করেন না। কিন্তু 'কৃষ্ণকলি'-র নায়িকা শ্যামা চরিত্রটি তৈরিই করা হয়েছে এমনভাবে যে সে কখনও কোনও প্রতিবাদ করবে না। সমস্ত অবিচার, অত্যাচার সহ্য করে সে শুধু সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি। পুরুষ থেকে নারী, বেশিরভাগ দর্শকই এমন নায়িকাকেই টেলিপর্দায় আশা করে থাকেন।
দৃশ্যমাধ্যমে দর্শক সবচেয়ে বেশি একাত্ম বোধ করেন সেই চরিত্রগুলির প্রতি, যারা নিরীহ এবং সরল। কারণ প্রায় সব দর্শকই ওই ধরনের চরিত্রের মধ্যে নিজের প্রতিফলন কল্পনা করে থাকেন। এই ধারাবাহিকের তথাকথিত ভিলেন গুরুমা (শর্বরী) ও মেজবৌয়ের (রিমঝিম) চূড়ান্ত প্রতিহিংসাপরায়ণতার সামনে শ্যামা-র অপরিসীম সারল্য দর্শককে চুম্বকের মতো টেনে রাখে। তাই চূড়ান্ত একমাত্রিক কনটেন্ট হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণকলি সুপারহিট, ঠিক যেমনটা হয় বাণিজ্যিক ছবির ক্ষেত্রে।