শেষ কিছুদিনে এই রাজ্যে যা ঘটেছে, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আরজি কর কাণ্ডের পর থেকেই নারী নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বারবার নারী সুরক্ষা নিয়ে পথে নামছেন তারকারা। আর গতকাল রাত্রে ইন্ডাস্ট্রির বুকে যা ঘটেছে, তারপর থেকেই নানা আলোচনা।
এক হেয়ার ড্রেসার গতকাল রাতে আত্মহত্যা করতে যাওয়ার পর থেকেই, ফের একবার গিল্ড এবং ফেডারেশনের দিকে আঙুল উঠছে। বেশ কিছু মাথা মিলেই দিনের পর দিন টেকনিশিয়ান এবং পর্দার পেছনে থাকা সকলকে মানসিক অত্যাচার করে আসছে। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, সেই দলের মাথার একটি ক্যাপ্টেন রয়েছে। এবার পরিচালকদের তরফে দেওয়া হয়েছে একটি বিবৃতি। যাতে লেখা...
এ রাজ্যের সকল সিনেমাকর্মী, টেলিভিশনকর্মী, ওটিটি, শর্ট ফিল্ম, বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও আমাদের কাজের যারা দর্শক, সেই নাগরিক সমাজকে কিছু কথা জানানোর খুবই দরকার। জল অনেকদিন ধরেই বাড়ছে, এখন বিপদ ঘন্টা বেজে গেছে, রাজ্যের গ্রামাঞ্চলেও, আমাদের কর্মস্থলেও। আমাদের সহকর্মী এক কেশ বিন্যাস শিল্পী কাল রাতে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। কারণ, তিনি ফেডারেশন( FCTWEI) ও ফেডারেশন অন্তর্ভূক্ত ওঁর গিল্ড সিনে এন্ড ভিডিও হেয়ার স্টাইলিস্ট এসোসিয়েশন এর গনতান্ত্রিক পদ্ধতি নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলায় তাঁকে কাজ থেকে আড়াই মাস মতো সাসপেন্ড করা হয়। তাঁর প্রাক্তন স্বামী অসুস্থ হওয়ায় তিনি তাঁর শুশ্রুষার ভার নেন, তিনি একাই তাঁর ছোট মেয়ের কলেজের পড়াশুনো চালান কাজ করে, এই সাসপেনশনের ফলে পরিবার দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। ভয়ঙ্কর আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হন তিনি ও তাঁর পরিবার । এমন সময় তার সাসপেনশন এর মেয়াদ শেষ হয়, এরপর আসে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। ওঁর গিল্ড ওঁকে জানায় উনি কাজ করতে পারবেন, তবে শুধুমাত্র তাদেরই বলে দেওয়া কাজে তিনি যোগদান করতে পারবেন। নিজের ইচ্ছানুসারে কাজ নিতে পারবেন না। এবং যদি এরপর ফেডারেশনের কর্মপদ্ধতি বা গিল্ডের নিয়ম কানুন নিয়ে কোনো সমালোচনামূলক মন্তব্য বা আলোচনা করেন, তবে আরো কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমাদের সহকর্মী একটি সুইসাইড নোট লেখেন, তাতে নিজের এই চরম সিদ্ধান্তের জন্য যাদের দায়ী করেন,তারা প্রায় প্রত্যেকেই সিনে ও ভিডিও হেয়ার স্টাইলিস্ট এসোসিয়েশন এর সদস্য ও পদাধিকারী।"
সেই বিবৃতিতে ইন্ডাস্ট্রির গিল্ড এবং ফেডারেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিচালকরা। তাঁরা আরও লিখছেন, "আমরা, ইন্ডাস্ট্রির মানুষেরা সকলেই জানি, ফেডারেশন এর আওতায় এই ২৬ টি আলাদা গিল্ড আদপে পাপেট, ফেডারেশনের মূল কার্যকরী কমিটির অঙ্গুলিহেলনে ও চাপে তারা এই সমস্ত ভ্রান্ত, আইন বিরুদ্ধ, খাপ পঞ্চায়েত সুলভ অনৈতিক, নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত বলবৎ করতে বাধ্য থাকেন। এই দাদাদের আপন দেশে, আইন কানুন সর্বনেশে। কারা বা কী এই ফেডারেশন। অত্যন্ত জরুরি এক সংগঠন। ট্রেড ইউনিয়ন। যারা বিনোদন শিল্পের কলাকুশলীদের কাজ করে টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তার, কাজের পরিবেশের, সম্মানের ও স্বাস্থ্যের স্বার্থে কাজ করেন। যাকে ছোট করে welfare organisation বলা চলে। কিন্তু,কোনো শিল্পীকে তিন মাস কেন, তিন মিনিট সাসপেন্ড করার অধিকার এই সংগঠনের নেই। কীভাবে ,কতজন কলাকুশলী নিয়ে কতক্ষণ কাজ হবে....এক কথায় একটা ইন্ডাস্ট্রির কর্ম পদ্ধতি কী,তা ঠিক করার এক ছটাক অধিকার এই সংগঠনের নেই। আমাদের দেশে নিয়ম নীতি তৈরি হয় সংসদে, আইনি তদারকী তে। এসব জানা সত্ত্বেও সংসদীয় ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পাড়ার ক্লাব বা আপিস চালানোর কায়দায় তারা দিনের পর দিন এই কান্ড ঘটিয়ে চলেছেন। সম্পূর্ণ আইনি এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে। কীভাবে? গায়ের জোরে? ক্ষমতার জোরে?বেআইনি উপায়ে? এবং এদের এই তুঘলকী কাজের কায়দা যে সম্পূর্ণ বেআইনি, তা প্রমাণ করতে কোনো গোয়েন্দা সংস্থা লাগবে না, যে কোনো উকিলকে তার চেম্বারের দরজা থেকে জিজ্ঞেস করলেই তিনি বলে দেবেন। এসব সত্ত্বেও এতজন কলাকুশলী এসব মেনে নিয়ে চলেন কেন !! চিরকালীন সহজ সত্য। দিন মজুরিতে যারা কাজ করেন, তাদের নিরাপত্তাহীনতায় ধুয়ো দিয়ে তাদের ভয় দেখানো ও ভোলানো। তাদের কাছে ঈশ্বর হয়ে ওঠা। এই জিনিস চলতে চলতে আজ আমাদের সহকর্মী একেবারে মৃত্যুর চৌকাঠ অবধি পৌঁছে গেছেন।"
হেয়ার ড্রেসারেরব সঙ্গে হওয়া অন্যায় তাঁরা মেনে নিতে নারাজ। তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, তবে পরিচালকরা বলছেন, আমাদের সহকর্মী এখন বিপদের বাইরে। বাঙ্গুর হাসপাতাল থেকে তাঁকে বাড়ি পাঠালেও ওঁর মানসিক নির্যাতনের জন্য নিয়মিত ট্রমা কাউন্সেলিং দরকার!আজ আমাদের সহকর্মী মর্মান্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তাই আমাদের শঙ্কা স্বাভাবিক, কিন্তু এরকম ঘটনা নতুন নয়। যে দম বন্ধ করা, কুৎসিত, নিরাপত্তাহীন ও হিংস্র পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে কতিপয় কমিটি মেম্বারদের মৌরসি পাটটা বজায় রাখতে, তাদের ক্ষমতা ও খামখেয়ালীপনাকে তুষ্ট করতে, তা এই ইন্ডাস্ট্রি তে শিল্প নির্মাণের পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। আমরা সকল সহকর্মী দের কাছে আবেদন রাখছি, আপনারা কে কোন গিল্ডের, কোন সংগঠনের এসব বিচার না করে আসুন, আমরা একসঙ্গে এই অশুভ আতাঁত এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। আজ না দাঁড়ালে আর কোনদিনই পারব না। সময় এসেছে টেকনিশিয়ানদের মঙ্গল করার ভনিতার আড়ালে এই বেআইনি কার্যকলাপে লিপ্ত মানুষদের আসল রূপ চিনে নেওয়ার। ঢাকঢোল পিটিয়ে *সুরক্ষা বন্ধু* ঘোষণার কয়দিনের মধ্যে আমাদের বন্ধু সহকর্মী হতাশায় আর মানসিক যন্ত্রণায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। যাদের সিদ্ধান্তে এই ঘটনা ঘটল, সত্ত্বর তাদের অপসারণ আমরা চাই । চাই সমস্ত বেআইনি নিয়ম বাতিল হোক।"