/indian-express-bangla/media/media_files/2025/05/01/N9itDyiYBGOIfjzPAmOH.jpg)
'নায়ক'-এ কেন তৃপ্ত সত্যজিৎ রায়?
Satyajit Ray-Uttam Kumar: যেদিন মহানায়ক উত্তম কুমার চির ঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন ঠিক তার দু'দিন পর অর্থাৎ ১৯৮০ সালের ২৬শে জুলাই তাঁর স্মৃতিচারণে আনন্দবাজার পত্রিকায় 'নায়ক' স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় তাঁর মনের কথা লিখেছিলেন। মহানায়কের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন। কিংবদন্তী পরিচালক লিখেছিলেন, 'উত্তমকুমারকে যখন প্রথম ছবিতে দেখি তখনও আমি নিজে ছবির জগতে আসিনি। নতুন একটি হিরোর আবির্ভাব হয়েছে বলে শুনছিলাম। ছবিটিও নাকি ভাল, তাই 'সাড়ে চুয়াত্তর' দেখতে গেলাম। নির্মল দে-র ছবি মানেই দুর্দান্ত পরিচালনা, আঁটসাট চিত্রনাট্য। এই বিশেষ পরিচালকের কাজ ভাল লেগেছিল বলেই পরে দেখলাম 'বসু পরিবার' ও 'চাঁপাডাঙার বউ'। তিনটি ছবি পর পর দেখে, মনে হল উত্তমকুমারের অভিনয় ও ব্যক্তিত্বে সত্যিই একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের দুর্গাদাস, প্রমথেশ, ধীরাজ, জহর গাঙ্গুলী প্রমুখের কাজের সঙ্গে এর বিশেষ মিল নেই। মনে হল ছেলেটি হলিউডের ছবিও দেখে। অভিনয়ে থিয়েটারের গন্ধ নেই, চলন-বলনে বেশ একটা সাবলীল স্বাচ্ছন্দ্য। ক্যামেরা বস্তুটিকে যেন বিশেষ তোয়াক্কা করে না। তার উপরে চেহারা ও হাবেভাবে বেশ একটা মন টেনে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। উত্তমকুমারের ভবিষ্যৎ আছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।'
আরও লেখেন, 'দশ-বারো বছর পর উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসে আমার। ইতিমধ্যে উত্তম-সুচিত্রার রোম্যান্টিক জুটি দর্শকদের মন জয় করেছে। লেখক পরিচালক প্রযোজক দর্শক সকলের চাহিদা চলে গেছে প্রেমের গল্পের দিকে। 'অগ্নিপরীক্ষা' বা 'হারানো সুর' দেখে এটা বুঝেছিলাম যে এই জুটির সাফল্যের পিছনে লেখক প্রযোজক পরিচালক দর্শক সমালোচক ফিল্ম-পত্রিকা সম্পাদক ইত্যাদি সকলের যতই অবদান থাকুক না কেন এদের দু’জনের মধ্যেই এমন সব গুণ বর্তমান যার রাসায়নিক সংমিশ্রণে সোনা ফলতে বাধ্য। শুধু উত্তমের কথা বলতে গেলে এটা বলা যায় যে নায়িকার সান্নিধ্যে এলেই অনেক নায়কের মধ্যেই সিঁটিয়ে যাওয়ার ভাবটা ক্যামেরায় অব্যর্থ ভাবে ধরা পড়ে, উত্তমকুমারের মধ্যে সেটি নেই। বরং প্রেমের দৃশ্যে এঁর অভিনয় সবচেয়ে বেশি সাবলীল। নারী-পুরুষের সম্পর্ক যেখানে চিত্রকাহিনির অন্যতম প্রধান উপাদান, সেখানে এটা যে কত বড় গুণ সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।'
আরও পড়ুন: শুধু 'মহানায়ক'-ই নন দুর্দান্ত টেনিস খেলোয়ারও, উত্তমকুমারের এই খেলা শেখার নেপথ্য কারণ জানলে অবাক হবেন
সত্যজিতের সংযোজন, 'উত্তমকুমারের কথা ভেবেই 'নায়ক'-এর গল্প আমি লিখি । সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের এক অভিনয়-পাগল যুবক ছবিতে নেমে তরতরিয়ে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। এই অবস্থায় এই যুবকের মনে কী ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে, তার মূল্যবোধে কী পরিবর্তন হতে পারে, এও ছিল গল্পের বিষয়। চিত্রনাট্য শুনে উত্তম খুশি হয়। তার একটা কারণ হতে পারে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে কাহিনির সাদৃশ্য। আলোচনা করে বুঝলাম যে গল্পের গভীরে প্রবেশ করতে না চাইলেও, বা না পারলেও, তাঁর চরিত্রটি কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে সেটা উত্তম মোটামুটি বুঝে নিয়েছে। তাঁকে আগেও বলে রেখেছিলাম যে, সে যে ধরনের প্রেমের গল্পে অভিনয় করতে অভ্যস্ত, এটা সে ধরনের গল্প নয়। সুতরাং তাঁকে গতানুগতিক পথ কিছুটা ছাড়তে হবে। এতে যে প্রেম আছে, তা প্রচ্ছন্ন। এতে নায়কের দোষ-গুণ দুই আছে, এবং তা যে শুধু অন্তরে তা নয়। তাঁকে বললাম যে তোমার গালে যে সাম্প্রতিক পানবসন্তের দাগগুলি রয়েছে, সেগুলি ক্যামেরায় বোঝা যাবে, কারণ তোমাকে মেকআপ ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এই সব প্রস্তাবে তাঁর সামান্য প্রাথমিক দ্বিধা উত্তম সহজেই কাটিয়ে উঠেছিল।'
কাজ করে এতটাই তৃপ্ত হয়েছিলেন যে তিনি লিখেছিলেন, 'এটা বলতে পারি যে উত্তমের সঙ্গে কাজ করে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম, তেমন তৃপ্তি আমার এই পঁচিশ বছরের ফিল্ম জীবনে খুব বেশি পাইনি। উত্তম ছিল যাকে বলে খাঁটি প্রফেশনাল। রোজকার সংলাপ সে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে কাজে নামত। তাঁর অভিনয় ক্ষমতা ছিল সহজাত। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর দখল ছিল ষোলো আনা। ফলে স্বভাবতই তাঁর অভিনয়ে একটা লালিত্য এসে পড়ত। রোজই দিনের শুরুতে সেদিনকার বিশেষ কাজগুলি সম্পর্কে একটা প্রাথমিক আলোচনার পর আমাকে নির্দেশ দিতে হত সামান্যই। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, নিছক নির্দেশের বাইরেও সে মাঝে মাঝে কিছু সূক্ষ্ম ডিটেল তাঁর অভিনয়ে যোগ করত যেগুলি সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব অবদান। এই অলংকরণ কখনই বাড়াবাড়ির পর্যায় পড়ত না; এটা সব সময়েই হত আমার পক্ষে একটা অপ্রত্যাশিত উপরি প্রাপ্তি। বড় অভিনেতার একটা বড় পরিচয় এখানেই। 'নায়ক'-এর পর 'চিড়িয়াখানা' ছবিতে উত্তমের সঙ্গে কাজ করেও একই তৃপ্তি পেয়েছি। 'চিড়িয়াখানা' ছিল নায়িকা-বর্জিত ছবি। ফলে বলা যেতে পারে উত্তমের পক্ষে আরও বড় ব্যতিক্রম।'
সত্যজিৎ রায় কাগজে পড়ে জানতে পেরেছিলেন উত্তমকুমার নাকি আড়াইশোর উপর ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। এর মধ্যে অন্তত দুশো ছবি যে অচিরেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে তাতে কোনও সন্দেহ প্রকাশ করেননি। যে দেশে সৎ অভিনেতার সদ্ব্যবহার করতে জানা লোকের এত অভাব, সেখানে সেটাই স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু শিল্পীর বিচার সবসময়ই হয় তার শ্রেষ্ঠ কাজের উপর সেই ভরসা ছিল সত্যজিতের। তাঁর কথায়, 'উত্তমের অভিনয়ের পরিধি যে খুব বিস্তৃত ছিল তা নয়, কিন্তু তার এই নিজস্ব পরিধিতে ক্রমান্বয়ে ত্রিশ বছর ধরে সে যে নিষ্ঠা ও ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে গেল, তার তুলনা নেই। তাঁর অভাব পূরণ করার মতো অভিনেতা আজ কোথায়?'