খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সারা পৃথিবীতেই এর মূল্য একেবারে যেন পাখা মেলে আকাশে উড়ে গিয়েছে। প্রথমত রয়েছে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ, এতে করে হয়েছে কি এ দুটি দেশ থেকে গম এবং সার রফতানি প্রবল ধাক্কা খেয়েছে। সেই সঙ্গে খরা, বন্যা এবং তাপ প্রবাহের ধাক্কায় চাষাবাদে ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। এ ছাড়াও আরও টুকটাক কারণও রয়েছে এই গড়গড়িয়ে দামবৃদ্ধির, যেমন বেআইনি মজুতদারি কালোবাজারি ইত্যাদি। এখানে বলি, গমের দাম মার্চে ১৪ বছরে সর্বোচ্চ হয়েছে, ভুট্টার দাম সর্বকালীন রেকর্ড করেছে। শুক্রবার এই তথ্য দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অফ এক্সপার্টস অন সাসটেনেবল ফুড সিস্টেমের (IPES) রিপোর্ট।
আসুন দাম বৃদ্ধির কারণে আতসকাচ দেওয়া যাক
রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুযুধান। পৃথিবীর গম রফতানির ৩০ শতাংশ এই দুই দেশের উপর নির্ভরশীল। এই রফতানিটা পুরো ঘেঁটে গিয়েছে যুদ্ধের ফলে। এতে গম রফতানি নিয়ে অন্য দেশগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। দামও বেড়ে গিয়েছে সেই মতো। দাম বৃদ্ধি মানে গরিবের পেটে প্রহার, গরিব দেশগুলি, যারা ঋণভারে জর্জরিত তাদের করুণসংঙ্গীত শোনা যাচ্ছে। আফ্রিকার আমদানির ৪০ শতাংশ গম ইউক্রেনের। ফলে সেখানে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। আর, আইপিইএসের রিপোর্ট বলছে, গমের দাম বৃদ্ধির ফলে লেবাননে পাউরুটির দাম ৭০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। বুঝতেই পারছেন, স--ত্ত--র শতাংশ, কী ভয়ঙ্কর! তবে, যুদ্ধই একমাত্র কারণ নয়, এ ছাড়াও রয়েছে প্রকৃতির রোষ, যা আমরা লেখার গোড়াতেই বলেছি। কিন্তু এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায়টা কী?
চাষাবাদ বাড়িয়ে কি এই সমস্যার মূলে আঘাত করা যায় না ?
যায়। বেশ কিছু গম উৎপাদক দেশ এ ব্যাপারে পরিকল্পনা করেছে ইতিমধ্যেই। ভারতের তরফে বলা হয়েছে, আরও বেশি গম রফতানি করে বিশ্বসঙ্কটের সঙ্গে লড়াইয়ে নামবে। কিন্তু আমাদের এখানে চলা তাপপ্রবাহের জেরে উৎপাদনের ধাক্কা আসতে পারে, ফলে সেই সতর্কতার চোখ রাঙানি থাকছে। দেখা যাক কী হয়! যদিও এই চাষাবাদ বৃদ্ধির এই প্রচেষ্টা, সেইটা আরেকটি কারণেও ধাক্কা খাচ্ছে, আরও খাবেও। তা হল বিশ্বজোড়া সারের অভাব। গত বছর রাশিয়া এবং বেলারুশ পৃথিবীর ৪০ শতাংশ পটাশ রফতানি করেছিল। যুদ্ধের কারণে সেই রফতানির খুঁটিও উপড়েছে অনেকটা, সার না পেয়ে গাছ মুষড়ে পড়ে আছে। খাদ্য দিচ্ছে না।
খাদ্য নাই, কী করে পাই?
যেহেতু বিপুল পরিমাণে দানাশস্য গবাদি পশুকে খাওয়ানোর জন্য খরচ হয়, ফলে যদি মাংস এবং দুধজাত খাবার খাওয়া আমরা কমিয়ে দিই, তা হলে ওই বাড়তি দানাশস্য মানুষের খিদে মেটাতে পারবে। বলছেন কৃষি বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। আন্তর্জাতিক বাজারে ডালজাতীয় শস্যের অভাব রয়েছে ২০ থেকে ২৫ মিলিয়ন টন, এখন ইউরোপীয়রা তাদের প্রাণজ পণ্য খাওয়া কমায় অন্তত ১০ শতাংশ, তা হলে ডালের চাহিদা কমে যাবে ১৮ থেকে ১৯ মিলিয়ন টন। যা মানুষ পাবে খেতে। যদিও এর ফলে দুধ এবং মাংসের বাণিজ্যে ধাক্কা আসবে সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন- বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের পালটা? আপ বিধায়কের বাড়ি-সংস্থায় অভিযান সিবিআইয়ের
শস্য উৎপাদনের খামতি কাটানোর আরও একটি রাস্তার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। যে সব দেশ খাদ্যশস্য আমদানির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল, তাদের দেশের প্রধান খাদ্যশস্যগুলি উৎপাদনে সাহায্য করতে হবে। রফতানি করার জন্য খাদ্যপণ্য উৎপাদনের বদলে দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য উৎপাদন করার দিকে নজর দিতে হবে ভাল করে, আরও কড়া ভাবে। অনেক সময়তেই প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনের বদলে বাণিজ্য-যোগ্য খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো হয়ে থাকে। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী, একশো বার ঠিক কথা, কিন্তু যদি দেশে খাদ্যই না থাকে তা হলে ধন দিয়ে কাজ কি হবে? তা ছাড়া, নীতি-বদল করতেও হবে। ধরা যাক আফ্রিকার কথা, তাদের আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। এবং এটাই বোধ হয় সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপের উচিত সময়।
খাবার নষ্ট করা যাবে না, বা তা কমিয়ে ফেলতে হবে যতটা সম্ভব। মানুষের জন্য যে খাদ্য তৈরি হয় সারা পৃথিবীতে মোটামুটি তার এক তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়ে যায়। যার পরিমাণ ১.৩ বিলিয়ন টন বা ১৩০ কোটি টনের মতো। এই নষ্টের পরিমাণ কমালে, কত মানুষই যে খাবার খেতে পারবে, তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের জ্ঞানচক্ষুটা এখনও না খুললে, মহা-মন্বন্তর এল বলে!
Read story in English