গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট আসামের এনআরসি-র ফাঁস হওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কোনও বিতর্ক শুনবে না বলে জানিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিয়েছে ৩১ অগাস্ট চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশ করতে হবে, তাতে কেউ খুশি হোক বা না হোক। এর ফলে রাজ্য সরকার বিধানসভায় তথ্য দিয়ে পুনর্যাচাইয়ের যে দাবি তুলেছিল তাও নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
বিধানসভায় কী ধরনের তথ্য দেওয়া হয়েছে?
সরকারের মতে গত বছর জুলাই মাসে চূড়ান্ত খসড়া এনআরসি প্রকাশিত হয়েছে সেখান থেকেই এই তথ্য নেওয়া হয়েছে। সেখানে এনআরসি-তে ৩৩টি জেলার যাদের নাম বাদ পড়েছে এবং যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাদের তালিকা রয়েছে। আসামের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশে গত বছরেই জেলা ওয়ারি এই তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু এনআরসি কর্তৃপক্ষ এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। তা ছাড়া নামের অন্তর্ভুক্তি এবং তালিকাছুট দুইয়ের সংখ্যাই এখন বদলে গিয়েছে।
আরও পড়ুন, আসাম এনআরসি: কেন তেজপুর জেলে পচছেন আমিলা শাহ
গত বছর এনআরসি কর্তৃপক্ষ জেলাওয়ারি কোনও হিসেব দেয়নি এনআরসি কর্তৃপক্ষ, তারা কেবল পুরো আসামের তথ্য দিয়েছিল।
জেলাওয়ারি তথ্যের তাৎপর্য কী?
ভৌগোলিক অবস্থান এবং জনবিন্যাস বোঝা যায় এর থেকে। বিজেপির মন্ত্রী তথা সরকারের মুখপাত্র চন্দ্রমোহন পাটোয়ারি তথ্য প্রকাশ করার সময়ে একটি নির্দিষ্ট প্রবণতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন বাংলাদেশ সংলগ্ন জেলায় অন্তর্ভুক্তির হার বেশি এবং যে সব জায়গায় দেশীয় মানুষের বাস সে সব জেলায় অন্তর্ভুক্তির হার কম। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়ে এই প্রবণতা থেকেই স্পষ্ট য়ে এনআরসি-তে অনেক ভ্রান্তি রয়েছে। এই বক্তব্য রাখার মাধ্যমে একটা কথা অনুমান করে নেওয়া হচ্ছে যে সীমান্ত জেলাগুলিতে বেআইনি উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেশি। পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরা আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে কিন্তু বহু দশক ধরে বাস করে আসছেন।
ধুবড়ি, দক্ষিণ সালমারা এবং করিমগঞ্জ- এই তিনটি সীমান্ত জেলায় মুসলিম জনসংখ্যা বেশি। অন্যদিকে যে দুই জেলায় তালিকাছুটের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি সেই হোজাই এবং দরং জেলায় মুসলিম জনসংখ্যা বেশি হলেও এ দুটি জায়গায়ই সীমান্ত থেকে দূরবর্তী।
জনবিন্যাসের মাধ্যমে অভিবাসন সম্পর্কে কী জানা যায়?
অভিবাসীরা যে মূলত মুসলিম, সে কথা বহুল মাত্রায় স্বীকৃত। কিন্তু পাল্টা একটা যুক্তিও রয়েছে, বাঙালি মুসলমানরা ব্রিটিশ শানের সময় থেকেই আসামে আসছেন। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর থেকে যারা আসামে অভিবাসী হয়েছেন, তাঁরা বেআইনি হিসেবে গণ্য হবেন।
আরও পড়ুন, এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর ভারত কি সত্যিই কাউকে ফেরত পাঠাতে পারে
জেএনইউ-য়ের পপুলেশন স্টাডিজের অধ্যাপক ডক্টর নন্দিতা সইকিয়া জনগণনার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছেন পূর্ব বঙ্গ ছেড়ে ৮৫ শতাংশ মুসলিম অভিবাসী এসেছেন ১৮৯১ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে এবং দুই তৃতীয়াংশ অভিবাসী এসেছেন ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ এর মধ্যে। ১৯৭১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে আসামের মুসলিম জনসংখ্যা যে ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশ হয়েছে, তা তাঁর মতে স্বাভাবিক বৃদ্ধি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশিবিজ্ঞানের (স্ট্যাটিসটিক্স) অধ্যাপক আব্দুল মান্নান অবশ্য মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির পিছনে স্বাভাবিক কারণই দেখছেন। তাঁর কথায় মুসলিম জনসংখ্যার একটি অংশের সন্তানজন্মের হার বেশি। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তার কারণ শিক্ষার অভাব, পশ্চাৎপদতা প্রভৃতি। তিনি বলছেন করিমগঞ্জ বা অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলায় প্রথম জনগণনার সময় থেকেই মুসলিমরা সংখ্যাধিক বলে দাবি করেছেন তিনি।
ধর্মীর জনবিন্যাসের কথা যদি বাদও দেওয়া হয়, তাহলেও গোটা অভিবাসনের বিষয়টি নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। সাংবাদিক তথা কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের ইন্টারন্যাশনাল ডিরেক্টর সঞ্জয় হাজারিকা বলছেন, "এ বিষয়টি এত সহজ নয়, ধর্মীয় জনবিন্যাস দিয়ে সংখ্যা বুঝে ফেলার মত সরল বিষয় এটি নয়। সম্প্রদায়ের বৃদ্ধির হার, সব মিলিয়ে এবং গোষ্ঠীগতভাবে সন্তানজন্মের হার (বিভিন্ন বয়সের মহিলারা কত সন্তানের জন্ম দেবেন), মৃত্যুর হার- এ সব রয়েছে। কারোর কাছে কোনও পরিষ্কার ধারণা নেই। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, তাদের কোনও নাগরিক ভারতে অভিবাসী হননি।"
এনআরসি কি এই অনিশ্চয়তা স্পষ্ট করবে না?
হাজারিকার কথায়, "যদি যথার্থ ভাবে এ কাজ হত, তাহলে একটা গ্রহণযোগ্য সংখ্যা বেরিয়ে আসত। এখন এই তথ্য ঘিরে এত বিতর্ক হচ্ছে, কে কেন ঢুকে পড়েছে বা বাদ গেছে, কেনই বা- এসবটাই দীর্ঘ ক্লান্তিকর এক প্রক্রিয়া। দরিদ্রতম, অরক্ষিততম মানুষটা সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হাততালি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সে সব তথ্য বা যুক্তির সত্যের থেকে বহু দূরে।"
আরও পড়ুন, সামনে এনআরসি, ডুবলেও বাড়ি ছাড়তে চাইছেন না বন্যার্ত আসামবাসী
গবেষকদের মধ্যে সইকিয়া অনআরসি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, বলেছেন কোনও পাইলট প্রজেক্ট ছাড়াই এ কাজ করা হচ্ছে। উল্লেখ্য ২০১০ সালে এ প্রচেষ্টা হয়েছিল বটে, কিন্তু বিক্ষোভের জেরে তা বন্ধ করে দিতে হয়। সুপ্রিম কোর্ট পুনর্যাচাইয়ের অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে দুর্ভাগ্যজনক বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে আব্দুল মান্নানের মতে এনআরসি নিয়ে সরকারের যে বক্তব্য তা সম্পূর্ণ প্রচার যার তথ্যভিত্তি নেই। তিনি বলেন, "এনআরসি প্রকাশিত হওয়ার আগে যদি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ না হয়, তাহলে একটি ১৯৭১ সালের পরে এদিকে আসা একটি বড়সংখ্যার মানুষ যাঁদের নথিপত্র নেই, তাঁরা এনআরসি-তে তাঁদের নাম পাবেন না।"
নামের অন্তর্ভুক্তির বদলে তালিকাছুট সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠল কেন?
বেশি সংখ্যায় মুসলিম নাম তালিকায় ঢুকলে বেশি সংখ্যার হিন্দু বাঙালির বাদ পড়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। এদিকে বিজেপি রক্ষা করতে চাইছে হিন্দু বাঙালিদের। গত এক বছরে হিমন্ত বিশ্বশর্মা সহ বিজেপি নেতারা জনসমক্ষেই বলছেন তাঁদের আশঙ্কা বড়সংখ্যক হিন্দুদের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়বে। যদি সত্যিই তেমন হয়, তাহলে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করিয়ে ওই হিন্দুদের নাগরিকত্ব রক্ষার চেষ্টা করবে বিজেপি।
রাজ্যের বিজেপি সভাপতি রঞ্জিত দাস ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, "আমরা আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে অনুরোধ জানিয়েছি য়ে শুধু এনআরসির উপর ভিত্তি করে কাউকে বিদেশি আখ্যা দেওয়া ঠিক হবে না। আমরা নাগরিকত্ব বিল পাশ করাতে বদ্ধপরিকর, তার আওতায় অনেকে ঢুকে পড়বেন। এটা ভোট ব্যাঙ্কের প্রশ্ন নয়, নৈতিক দায়িত্বের ব্যাপার।"
Read the Full Story in English