সামনে এনআরসি, ডুবলেও বাড়ি ছাড়তে চাইছেন না বন্যার্ত আসামবাসী
মরিগাঁওয়ে ৫ লক্ষের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। লহরীঘাট রেভিনিউ সার্কেলে, যেখানে রিনা বেগমের বাড়ি, সেখানে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা ১ লক্ষ। গত পাঁচদিন ধরে সেখানে উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এনডিআরএফ।
উদ্ধারকর্মী পরবেশ বলছেন, "শুধু রিনা বেগমের পরিবারই এরকম নাছোড় নয়। অনেকেই নিজেদের বাড়ি ছাড়তে চাইছে না। তাল আমরা একটা প্রত্যন্ত জায়গায় গিয়েছিলাম। সেখানে একটা বাড়ির মধ্যে ২০ জন দাঁড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু আমাদের সঙ্গে এল শুধু সাতজন।" তা সত্ত্বেও সে মানুষগুলোকে নিজেদের ফোন নম্বর দিয়ে এসেছিলেন পরবেশরা। রাতে জল বাড়লে পরবেশ ফোন পান। "পরিস্থিতি খারাপ হলে স্বাভাবিকভাবেই ওঁদের মন বদলায়।"
আসামের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায়, বাড়ি আর জমি হল পরিচয়ের চিহ্ন। ৩১ জুলাই এনআরসি-র অন্তিম তালিকা প্রকাশের শেষ তারিখ। স্থানীয় প্রশাসনের একজন বলছিলেন, এ কারণেই ওঁরা সম্ভবত বাড়ি ছাড়তে ভয় পাচ্ছেন।
পরবেশের বক্তব্য, যাঁরা উদ্ধার হতে চাইছেন তাঁরা সমস্ত নথিপত্র আগে সামলে নিচ্ছেন। "অনেকবার নিরাপদ জায়গায় আসার পর মানুষজনকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে কারণ তাঁরা নথিপত্র আনতে ভুলে গিয়েছিলেন।"
রিনা বেগমের মেয়ে ও চার নাতনির একমাত্র নিরাপদ জায়গা হল তাঁদের বিছানাটা, যেটা দুটো লাঠি দিয়ে উঁচু করে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে ছোট নাতনির বয়স ৬ মাস। সেখানে যখন বাচ্চাটা ঘুমোয়, তখন ব্রহ্মপুত্রের জল চারপাশ খেলা করে। ওঁদের জামাকাপড় ভেসে গেছে, চেয়ারগুলো ঘোলা জলে উল্টোনো, দূরে বাথরুমের টিনের ছাদটুকু শুধু দেখা যায়।
৮ জুলাই বৃষ্টি যখন এল, রিনা তত গুরুত্ব দেননি। এরকম তো ঘটেই থাকে। জল যখন উঠতে শুরু করল, তাতেও পাত্তা দেননি তিনি। গত বছরও এরকম হয়েছিল।
রিনা ও তাঁর মেয়ে, আসামের মরিগাঁওয়ে (ছবি- টোরা আগরওয়ালা)
কিন্তু রবিবার বিকেলে যখন লহরীঘাট আর ভুরাগাঁওয়ের দুটো বাঁধ ভেঙে জল যখন কোমর অবধি উঠে এল, রিনা আর তাঁর মেয়ে ধান উপরে তুলতে শুরু করলেন। ওঁর জা আর তার মেয়েও তাই করল। ওঁদের স্বামীরা দিনমজুর, ডিব্রুগড়ে থাকেন।
বর্ষার প্রথম বন্যায় যে ৪২ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, রিনা তাঁদের একজন। আসামের ৩৩টি জেলার মধ্যে ৩০ টিই ক্ষতিগ্রস্ত, ৬৯৫টি ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন ১,৪৭,৩০৪ জন মানুষ। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের ৯৫ শতাংশ জলমগ্ন। অনেকেই বলছেন গত এক দশকেরও বেশি সময়ে এরকম আর হয়নি।
মরিগাঁওয়ে ৫ লক্ষের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। লহরীঘাট রেভিনিউ সার্কেলে, যেখানে রিনা বেগমের বাড়ি, সেখানে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা ১ লক্ষ। গত পাঁচদিন ধরে সেখানে উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এনডিআরএফ।
৪৫ বছর বয়সী সফিকুল ইসলাম কৃষক। তাঁর পরিবারের দুটি বাইক জলে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ছাগলগুলোও। তিনি বললেন, "এই দুর্বল বাঁধগুলো কোনও কাজের নয়। সব বালির তৈরি, ক্ষমতা নেই। বন্যা এলে আমাদের জন্য আরও ভাল পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করা প্রয়োজন।"
গ্রামগুলোতে চাল, ডাল, নুন পৌঁছেছে বটে কিন্তু বাসিন্দাদের দাবি তার পরিমাণ যথেষ্ট নয়, সমানভাবে ভাগও করা হয়নি। রেভিনিউ সার্কেল অফিসের এক আধিকারিক বললেন, "ত্রাণ আমাদের কাছে পৌঁছতে সময় লাগে। যেসব গ্রাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, সেখানকার লোকজনও ত্রাণ নিতে চলে আসে। সবাই যাতে ভাগ পায় তা নিশ্চিত করা দুঃসাধ্য।"
উদ্ধার কাজে এনডিআরএফ কর্মী (ছবি- টোরা আগরওয়ালা)
মঙ্গলবার কেন্দ্র ২৫১ কোটি টাকা সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছে কিন্তু রিনা বেগম ও তাঁর পরিবারের সারা দিন খাওয়া জোটেনি। ওঁর স্বামী ভোরবেলা এসে পৌঁছে সবার জন্য চিঁড়ে আনতে গিয়েছেন।
রিনা বললেন, "এ সপ্তাহে আজই প্রথম বৃষ্টি হল না। হয়ত এবার ভাল হয়ে যাবে।"
পরবেশ কুমার বলছেন জল নামতে সময় লাগবে। ততক্ষণ তিনি অপেক্ষা করবেন, যদি রিনার মন বদলায়, উনি ফোন করেন।