যে তিনটি দেশের নির্দিষ্ট ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষদের ভারতীয় নাগরিকত্বের ব্যাপারে নয়া নাগরিকত্ব আইনে বিশেষ সুবিধা দেবার কথা বলা হয়েছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ নিজে কীভাবে নাগরিকত্ব দেয় এবং তাদের সংবিধানে ধর্মের স্বাধীনতা কীভাবে দেওয়া রয়েছে, তা একবার দেখে নেওয়া যাক।
বাংলাদেশের সংবিধানে সে দেশকে কীভাবে বর্ণনা করে হয়েছে?
বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় ১৯৭২ সালের ৪ ডিসেম্বর। দেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঐতিহাসিক সংগ্রাম আখ্যা দিয়ে সংবিধানে একে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
পড়ে ফেলুন, পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইন কীরকম?
মৌলিক নীতি হিসেবে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে জাতীয়তা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার। বাংলাদেশের সংবিধানে সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থার বিষয়টি স্পষ্ট উল্লিখিত। বলা হয়েছে মৌলিক লক্ষ্য হল গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন- যে সমাজে আইনের শাসন থাকবে, থাকবে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা, সমস্ত নাগরিকের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, আর্থি ও সামাজিক সমতা ও ন্যায় সুরক্ষিত থাকবে। ভারতের সংবিধানে কিন্তু "আইনের শাসনের" কথা বলা নেই।
কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম তো ইসলাম?
১৯৭৭ সালে সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে "ধর্মনিরপেক্ষ" শব্দটি উড়িয়ে দেন। ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট হুসেন মহম্মদ এরশাদ সংবিধানে ২এ ধারা অন্তর্ভুক্ত করেন, যেখানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে বর্ণনা করা হয়। তবে সেখানে শান্তিতে অন্য ধর্মাচরণ করতে পারা যাবে বলেও বলা হয়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট এবং ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই সংশোধনী নাকচ করে দেয়। সুপ্রিম কোর্ট বলে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলেও সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষই থাকবে।
২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান সংশোধন করে ফের ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে "আল্লাহের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা" এই অংশটি সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে প্রস্তাবনার আগে "দয়াময়, ক্ষমাশীল আল্লাহের নামে" অংশটি রেখে দেওয়া হয়। অন্য ধর্মগুলিকেও স্থান দেবার উদ্দেশ্যে সেখানে উল্লেখ করা হয়, "আমাদের ক্ষমাশীল সৃষ্টিকর্তার নামে"।
রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা কীভাবে একসঙ্গে থাকতে পারে?
ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলেও অন্য ধর্মগুলিকে সমমর্যাদা ও সমানাধিকার দেওয়া হয়েছে সংবিধানে। অন্য ধর্মাবলম্বীরা স্বাধীন ভাবে তাঁদের ধর্মাচরণ করতে পারেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে সাধারণভাবে যা বোঝা হয়ে থাকে, তার সঙ্গে এর সঙ্গতি নেই।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৮(১) অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রনীতির মৌলিক ভিত্তি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১২ নং অনুচ্ছেদের পুনরুল্লেখ করা হয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মূল নীতিগুলি কী এবং তা কীভাবে আয়ত্ত করা সম্ভব সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানে এরকমভাবে বিষয়টির উল্লেখ নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা রয়েছে, সমস্ত রকমের সাম্প্রদায়িকতাকে চূর্ণ করে, সমস্ত ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দিয়ে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার ও ধর্মীয় বৈষম্যের বিরোধিতার করার মাধ্যমে, অথবা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মাচরণে নিগ্রহ দূর করার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা আয়ত্ত করা যাবে। এরকম প্রগতিশীল একটি বিধানের মাধ্যমে অন্তত সংবিধানের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় নিপীড়নের কোনও স্থান থাকে না- সে রাষ্ট্রধর্ম যতই ইসলাম হোক না কেন।
জেনে রাখুন, সারা ভারতের দিকে দিকে জারি ১৪৪, কী আছে এই ধারায়?
পাকিস্তানের সংবিধানের মত, প্রেসিডেন্ট বা অন্য সাংবিধানিক পদে বসার জন্য বাংলাদেশে কোনও মুসলিমত্বের প্রয়োজন নেই।
ধর্মের স্বাধীনতার বিষয়টি কীরকম?
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪১ নং ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের শৃ্ঙ্খলা ও নৈতিকতা মেনে যে কোনও ধর্মাচরণ বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ২৫ নং ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতাকে এর চেয়ে খর্বাকারে দেখা হয়েছে। সেথানে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা ছাড়াও এবং স্বাস্থ্য ও অন্যান্য মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলি যুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেখানে এও বলা হয়েছে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কারণে ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে। এমনকী ধর্মাচরণের সঙ্গে যুক্ত ধর্মনিরপেক্ষতায় খর্ব করতে পারে রাষ্ট্র। সমাজ সংস্কারের নামেও রাষ্ট্র এ স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে। তবে অন্য দিক থেকে ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতা বৃহত্তর- কারণ এ স্বাধীনতা শুধু নাগরিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
ভারতের সংবিধানের ২৬ নং অনুচ্ছেদের মতই বাংলাদেশের সংবিধানে ৪১(বি) অনুচ্ছেদে সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে ভারতে সরকারি খরচে বা পৃষ্ঠপোষকতায় চলা কোনও প্রতিষ্ঠানে কোনও নির্দেশ দেওয়া যায় না, বাংলাদেশে কিন্তু নিজে ধর্ম সম্পর্কে ধর্মীয় নির্দেশ দেওয়া যায়।
খেয়াল রাখুন, পেঁয়াজের দাম আপাতত কেন কমবে না
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদ ভারতীয় সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদের প্রতিলিপির মত। এখানে জন্মস্থান, ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ইত্যাদি বিষয়ের সাপেক্ষে বৈষম্য নিষিদ্ধ বলে বর্ণিত। বাংলাদেশে এর মধ্যে রাখা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও। ভারতের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মের ভিত্তিতে সমস্ত রকম বৈষম্য নিষিদ্ধ, যার ফলে সেখানে ধর্মীয় নিপীড়নের যুক্তিটি দুর্বল হয়ে পড়ে।
নাগরিকত্ব আইন কী বলছে?
বাংলাদেশের সংবিধানের ৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে এবং তাঁরা বাঙালি জাতি হিসেবে পরিচিত হবেন। ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির নির্দেষে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যে সব ব্যক্তি বা তাঁদের বাবা বা পিতামহ তৎকালীন বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে জন্মেছিলেন, তাঁরা সে দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন। কোনও ব্যক্তি যদি পড়াশোনা বা কাজের জন্য যুদ্ধরত দেশ (পাকিস্তান)-এ থেকে থাকেন ও সামরিক অপারেশনের জন্য সে সময়ে বাংলাদেশে ফিরতে পারেননি, তাঁরাও নাগরিক বলে গণ্য।
বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের মতই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোনও রাষ্ট্রের নাগরিককে নাগরিকত্ব দিতে পারে। কিন্তু তাঁর বাংলা জানা জরুরি। বাংলাদেশি পুরুষকে বিয়ে করার দু বছর পর কোনও বিদেশিনীও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেতে পারেন। জন্মস্থান যেখানেই হোক না কেন, বাবা-মায়ের যে কোনও একজন বাংলাদেশি হলে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের নিয়মে দেড় লক্ষ ডলার বিনিয়োগ করলেও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভব।
বাংলা বলতে পারেন না এমন কাউকে কি বাংলাদেশ নাগরিকত্ব দেয়?
যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানকে সমর্থম করা বহু মানুষ রাষ্ট্রহীন। কারণ মুক্ত বাংলাদেশ শত্রু দেশের সমর্থকদের নাগরিকত্ব দেয় না। ১৯৭২ সালে এরকম মানুষের সংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ। ভারত-পাক-বাংলাদেশ চুক্তির জেরে অনেকে পাকিস্তানে ফিরলেও আড়াই লক্ষ এমন মানুষ বাংলাদেশে রয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট সমস্ত উর্দুভাষীদের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করে। ১৯৫১ সালের পাক নাগরিকত্ব আইনও বলবৎ হয়। ২০১৬ সালে একটি খসড়া নাগরিকত্ব আইনও তৈরি হয় যাতে দু দেশের নাগরিকত্বের কথা বলা ছিল। কিন্তু নাগরিকত্ব খারিজের প্রসঙ্গও থাকায় ওই খসড়া নিয়ে সমালোচনাও হয় প্রচুর।
মিস করবেন না, নয়া নাগরিকত্ব আইন ১১ মাস আগের ক্যাব থেকে কোথায় আলাদা?
(ফৈজান মুস্তাফা সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ এবং হায়দারাবাদের নালসার আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য)