গত শুক্রবার অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ১০টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে চারটি বড় ব্যাঙ্ক তৈরির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। এই পরিকল্পনায় ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্স এবং ইউনাইটে় ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া সংযুক্ত হবে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সঙ্গে, কানাড়া ব্যাঙ্ক মিলে যাবে সিন্ডিকেট ব্যাঙ্কের সঙ্গে, অন্ধ্র ব্যাঙ্ক ও কর্পোরেশন ব্যাঙ্ক সংযুক্ত হবে মুম্বইয়ের ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে এবং এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক মিশে যাবে ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের সঙ্গে। এই পরিকল্পনার ভালো এবং মন্দ দিকগুলি কী দেখে নেওয়া যাক।
এই সংযুক্তি কীভাবে সাহায্য করবে?
বেশ কয়েক বছর ধরে এম নরসিংহম কমিটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ করে আসছিল ভারতে কম সংখ্যক বড়, ভালোভাবে পরিচালনাক্ষম ব্যাঙ্ক থাকা উচিত। এর ফলে মূলধনের যথাযথ ব্যবহার, পরিচালনায় দক্ষতা, বেশি লাভ ও বেশি নাগালের সুবিধা পাওয়া যাবে বলে মনে করছিল কমিটিগুলি। তার পক্ষে যুক্তি হল, দেশের নিজের ব্যাঙ্কগুলি একই ছোট ভূগোলের মধ্যে একই আমানত, একই ঋণের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় মাতছিল এই ব্যাঙ্ক। দেশের বড় শহরগুলির মধ্যে এ কথা ঠিকও বটে। যুক্তি হিসেবে এও বলা হয়েছিল যে বাজারের যে ধারা এবং বদল সেগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বড় ব্যাঙ্ক বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভাল ফল করতে পারে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, প্রস্তাবিত বড় ব্যাঙ্ক সারা দুনিয়ার সঙ্গে প্রতযোগিতায় নামতে পারবে এবং যদি তারা ঋণের খরচ কমাতে পারে এবং ঋণের পরিমাণ বাড়াতে পারে তাহলে তাদের পরিচালনায় দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ভারতের একটি ব্যাঙ্কও, এমনকি বৃহত্তম স্টেট ব্যাঙ্কও দেশের শীর্ষ ৫০টি ব্যাঙ্কের তালিকায় নেই। ফলে সে সম্ভবত অনেক দূরের কথাই।
সরকার কীভাবে উপকৃত হবে?
১৯৯২ সাল থেকে শুরু করে সরকার ২৫টি বেশি ব্যাঙ্কের বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার ও মূলধনের জোগানদাতা। আকারে বাড়তে এবং আরও ঋণদান করতে ব্যাঙ্কের প্রায়শই বেশি পরিমাণ মূলধনের প্রয়োজন হয় যাতে সম্ভাব্য অনাদায়ী ঋণের প্রভাব না পড়ে। বেশ বড় অংশের মূলধনই গত কয়েক বছর ধরে অনাদায়ী ঋণের জন্য ব্যয় হচ্ছে, সরকার ইকুইটি হোল্ডিং কমাতে নারাজ, এর ফলে মূলধন প্রবিষ্ট করানোর দায় বাড়ছে মূল শেয়ারহোল্ডারদের উপর। ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে আনার মাধ্যমে সরকার নিশ্চিতভাবেই আশা করছে এ ধরনের মূলধন প্রবিষ্ট করানোর পরিমাণ ক্রমশ কমবে, বেশি মূলধনক্ষম ব্যাঙ্কের দক্ষতা বাড়বে। এর ফলে সরকারকে এখন আগের চেয়ে অনেক কম ব্যাঙ্কের দিকে নজর দিতে হবে।
আরও পড়ুন, কেন ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্র?
নয়া সংযুক্তিতে ব্যাঙ্কগুলিকে বাছা হল কীভাবে?
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সরকার ব্যাঙ্কগুলিকে বাছার সময়ে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে যে ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় কোনও ঘাটতি হবে না এবং এই ব্যাঙ্কগুলির কারেন্ট ও সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে বেশি লাভবান হয়েছে। অতীতে সরকার এলাকাভিত্তিক সংযুক্তিকরণ নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনা করেছে। রঘুরাম রাজন যখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ছিলেন, তখন কথা হয়েছিল পূর্বাঞ্চলের দুর্বল ব্যাঙ্কগুলিকে সংযুক্ত করানোর। বর্তমান প্রস্তাবে একমাত্র সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ক ও কানাড়া ব্যাঙ্কের সংযুক্তির ব্যাপারে সে দিকটি বিবেচিত হয়েছে বলা চলে। পিএনবি নেতৃত্বাধীন সংযুক্তিতে ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্কও দিল্লি ভিত্তিক, অন্যদিকে অন্ধ্র ব্যাঙ্ক ও কর্পোরেশন ব্যাঙ্কের মত মধ্য ক্ষমতাসম্পন্ন দক্ষিণের ব্যাঙ্কগুলি পশ্চিম ভারত ও অন্যান্য জায়গায় ক্ষমতাশালী ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের পরিপূরক হতে পারবে। ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক অতীতে লাভের মুখ দেখেছে। কারেন্ট ও সেভিংস অ্যাকাউন্টে ক্ষমতাশালী এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক সহায়তাকারী ভূমিকা পালন করবে। এর ফলে তহবিলের উৎস অপেক্ষাকৃত সুলভ হবে।
সংযুক্তির সম্ভাব্য কুফল কী হতে পারে?
মসৃণ অপারেশনে সবসময়েই কিছু ঝুঁকি থাকে, বিশেষ করে সংযুক্ত ব্যাঙ্কগুলির কর্মী ও ইউনিয়নের তরফ থেকে বাধার সম্ভাবনা রয়েই যায়। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক ভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়া, কর্মীদের পুনঃস্থাপন এবং আরও কিছু বিষয়ে সমস্যা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সংযুক্তির পদ্ধতি কার্যকর হওয়ার সময়ে পরিষেবা খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গ্রাহকদের উপর এর প্রভাব পড়বে, তারণ মাঝারি আকারের এবং ছোট আকারের ব্যাঙ্কগুলিতে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকত তা আর থাকবে না। সংযুক্তির ফলে অনাদায়ী ঋণের সংযুক্তিও একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
এ ধরনের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান যেহেতু ফেল পড়ার সম্ভাবনা নেই, এ ক্ষেত্রে বেলআউটের সম্ভাবনা থেকে যাবে - যা সরকার এবং আর্থিক সুস্থিতিকে সমস্যায় ফেলবে।
শুধু সংযুক্তিই কি ভারতীয় ব্যাঙ্কের হাল ফেরাতে সক্ষম?
না, ব্যাঙ্কগুলির পরিচালনা একটা বড় সমস্যা, যা অনেক ব্যাঙ্কের অবনতির কারণ। সরকার এ ব্যাপারে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা আগে ঘোষণা করেছে। প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর ওয়াই ভি রেড্ডি একটি ভাষণে বলেছিলেন, সংযুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সমস্যার সমাধান হবে, এ ধারণা ঠিক নয়। তাঁর মতে, যে সমস্যা কাঠামোর ও পরিচালনার, ব্যাঙ্কের আকারের উপর তা নির্ভর করে না।
Read the Full Story in English