যেসব মহিলারা এই আইন মানেন না, তাঁদের ১৫০ ইউরো জরিমানা দিতে হয়। যেসব পুরুষ নিজেদের স্ত্রীকে বোরখা পরতে বাধ্য করেন, তাঁদের এক বছর জেল ও ৩০ হাজার ইউরো জরিমানা হতে পারে
ফ্রান্সের জিওন শহরে বাচ্চাকে নিয়ে স্কুল ট্রিপে যাচ্ছিলেন এক মহিলা। রাজনীতিবিদ জুলিয়েন ওদুল তাঁর হিজাব খুলতে বলেন। শনিবার নিউ ইয়র্ক টাইমসে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।
Advertisment
গত ১১ অক্টোবর এ ঘটনার কথা টুইট করেন ওদুল নিজে। "আমাদের প্রজাতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সাপেক্ষে আমি ওই মহিলাকে ইসলামি হিজাব খুলতে বলি। ৪ জন পুলিশকর্মীর হত্যার পর আমরা এ ধরনের সাম্প্রদায়িক উসকানি সহ্য করব না।"
ওই রিপোর্টে ওদুলকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, "ম্যাডামের কাছে অনেক সময় আছে, বাড়িতে বা রাস্তায় হিজাব পরার, কিন্তু এখানে নয়, আজ নয়।"
গত ২৫ সেপ্টেম্বর গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক রিপোর্টে ফরাসি শিক্ষামন্ত্রী জঁ মিশেল ব্ল্যাঙ্কারের বক্তব্য প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি বলেন, "হ্যাঁ আমি স্কুল ট্রিপে যাই, তাতে কী! ধর্মনিরপেক্ষতা মানে তো সকলকে আহ্বান করা।" তিনি আরও বলেন স্কুল ট্রিপের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে হিজাব পরিহিত মহিলাদের এড়াতে চান।
২০১৮ সালে ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ডেলি টেলিগ্রাফে তাঁর কলামে যাঁরা সারা শরীর বোর্খায় ঢেকে রাখেন, সেসব মহিলাদের লেটার বক্স এবং ব্যাঙ্ক ডাকাতদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
Advertisment
ফ্রান্স পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসাবে ২০১০ সালে সম্পূর্ণ মুখ ঢাকা হিজাব নিষিদ্ধ করে। ইসলামে যতরকমের ঘোমটা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে রক্ষণশীল হল বোরখা, যা পুরো মুখ ও শরীর আবৃত রাখে। চোখের সামনে একটি পাতলা পর্দা রাখা থাকে, যার মধ্যে দিয়ে দেখা যায়।
প্রেক্ষাপট
এই আইন কার্যকর হবার আগে, ২০০৪ সালে ফ্রান্স মাথার আচ্ছাদনী এবং স্পষ্টত ধর্মীয় চিহ্ন ধারণের ব্যাপারে সরকারি স্কুলগুলিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নিষিদ্ধ হয় পাগড়ি, ফেজ এবং ক্রস। এই আইন পাশ হবার আগে দু দশক ঘরে এ নিয়ে বিতর্ক চলছিল।
মুসলিম মহিলাদের ঘোমটা পরা নিয়ে ফরাসি জনগণের ধারণা, এ চিহ্ন মহিলাদের উপর নিপীড়নের প্রতীক। ফরাসি বিপ্লবের ধারণা গোটা ফ্রান্সে আদর্শ হিসেবে অতীব উচ্চস্থানে বর্তমান। সেখানে এই প্রতীক ধর্মনিরপেক্ষতার বিপ্রতীপ, যে ধর্মনিরপেক্ষতা ফরাসি বিপ্লবের ধারণার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।
ফরাসি সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা তিনটি নীতির উপর ভিত্তি করে রয়েছে, চেতনার স্বাধীনতা, এবং সামাজিক শৃঙ্খলার উপর আস্থাশীল সীমার মধ্যে থেকে বিশ্বাসঅনুযায়ী আচরণে রস্বাধীনতা, গণপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্নতা, এবং বিশ্বাস যাই হোক না কেন আইনের সামনে সমতা।
এ ছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষতা বিভিন্ন আচরণের স্বাধীনতা এবং ধর্মের স্বাধীনতা, তবে একই সঙ্গে ধর্ম থেকেও স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করে। কোনও ধর্মীয় গোঁড়ামি বা আচরণমালা মেনে চলতে কেউ বাধ্য ননয
ফ্রান্স এই নীতিগুলির ক্ষেত্রে এতটাই দায়বদ্ধ যে সরকার এ সম্পর্কে জনগণকে প্রশিক্ষিণ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে থাকে। সে দেশে ৮ ডিসেম্বর দিনটিকে জাতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়।
ফ্রান্সের বোরখা আইন
এই আইনানুসারে প্রকাশ্য স্থানে মুখ লোকানো নিষিদ্ধ। প্রকাশ্য স্থানের মধ্যে পড়ে পাবলিক রোড, যেসব স্থান জনগণের জন্য খোলা অথবা সরকারি পরিষেবা।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশ্যে মুখ ঢাকাকে বেআইনি ঘোষণা করে ফরাসি সেনেট। এ বিল পাশ হয় ২৪৬-১ ভোটে। ভোট দেননি ১০০ জন। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে বিল পাশ হয় ৩৩৫-১ ভোটে। এই আইনের ফলে প্রকাশ্যে বোরখা এবং নিকাবের মত মুখ ঢাকার পোশাক নিষিদ্ধ হয়। ধর্মীয় স্থানে প্রার্থনাকালীন অথবা গাড়িতে ভ্রমণকালীন সময়ে এ ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হয়।
যেসব মহিলারা এই আইন মানেন না, তাঁদের ১৫০ ইউরো জরিমানা দিতে হয়। যেসব পুরুষ নিজেদের স্ত্রীকে বোরখা পরতে বাধ্য করেন, তাঁদের এক বছর জেল ও ৩০ হাজার ইউরো জরিমানা হতে পারে। কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ককে বোরখা পরানো হলে এই জরিমানার পরিমাণ হয় ৬০ হাজার ইউরো এবং জেলবাস ২ বছরের। এই আইন পর্যটকদের জন্যও প্রযোজ্য। মানবাধিকারের ইউরোপিয় আদালত এই নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে।
অন্য দেশের আইন
ফ্রান্সের পর বেলজিয়াম ২০১১ সালে পুরো মুখ আবৃত করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এনেছে। সেখানে মহিলাদের এ ধরনের ক্ষেত্রে ১৩৭৮ ইউরো জরিমানা দিতে হয়, এমনকি সাতদিনের জেলবাসও হতে পারে। ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডস এ ব্যাপারে আংশিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যার ফলে মহিলারা মুখ আবরণী পরে স্কুল হাসপাতাল বা গণপরিবহণে যেতে পারবেন না।
এ ছাড়া চাড, ক্যামেরুন, তুর্কি ও সুইজারল্যান্ডে সম্পূর্ণ মুখ আবরণকারী পোশাকের ব্যাপারে কিছু আইন রয়েছে।