ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গিয়েছে, আগামী দু সপ্তাহের মধ্যে উত্তর ভারতের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াবে বলেই মনে করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস কি এই তাপমাত্রায় টিকে থাকবে! এই ভাইরাসের উপর তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার প্রভাব নিয়ে সারা বিশ্বে গবেষণা চলছে।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- হু বলেছে, “এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণাদি অনুসারে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া সহ সব জায়গাতেই এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।”
আইসিএমআর- ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের ডিরেক্টর জেনারেল বলরাম ভার্গব জোর দিয়ে বলেছেন, এই ভাইরাসের সংক্রমণের সঙ্গে তাপমাত্রার কোনও যোগ বর্তমানে নেই।
এইমস- এইমসের ডিরেক্টর রণদীপ গুলেরিয়া সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “খোলা জায়গায় ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রার উপর এই ভাইরাস সম্ভবত বেশিক্ষণ বাঁচবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। উষ্ণ এলাকাতেও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে এবং দ্বিতীয়ত, আমাদের অনেকেই ঘরের মধ্যে সময় কাটাই, যেখানকার তাপমাত্রা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থাকে... ফলে গ্রীষ্মকালে খোলা জায়গায় সংক্রমণ না হলেও ইনডোরে তার সম্ভাবনা থেকেই যায়।”
এবার বাঘের করোনা সংক্রমণ, বিড়ালজাতীয় প্রাণীরা কি অতিরিক্ত ঝুঁকিপ্রবণ?
গবেষণায় কী দেখা যাচ্ছে
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষকরা মনে করছেন কোভিড ১৯ মরশুমি রূপরেখা অনুসরণ করবে। সোশাল সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্কের এক অনলাইন পেপারে ডক্টর মহম্মদ সাজাদির গোষ্ঠী সংক্রমণের একটি দিকচিহ্ন পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। ৫ থেকে ১১ ডিগ্রি তাপমাত্রায়, এবং ৪৭ থেকে ৭৯ শতাংশ আর্দ্রতায় সংক্রমণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য বলে দেখিয়েছেন তাঁরা। ৩০ ডিগ্রি অক্ষাংশ থেকে ৫০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত এলাকায় এই আবহাওয়া বর্তমান।
এর মধ্যে রয়েছে উহান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ইরান, উত্তর ইতালি, সিয়াটল এবং উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া। ২০১৯ সালের মার্চ এপ্রিল মাসের তাপমাত্রার তথ্য ব্যবহার করে ওই গবেষণাপত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, গোষ্ঠী সংক্রমণ উত্তর দিকে পৌঁছবে। তাঁদের হিসেবে ঝুঁকিপ্রবণ এলাকার মধ্যে রয়েছে মাঞ্চুরিয়া, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ, ব্রিটিশ আইল, উত্তরপূর্ব ও মধ্য পশ্চিম আমেরিকা এবং ব্রিটিশ কলাম্বিয়া।
করোনা সংকটে পিছনের সারিতে চলে যেতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যু
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, “এই পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি অনুমান করা দুঃসাধ্য, তাহহলেও এমনটা প্রত্যাশা করা যায় যে কোভিড ১৯, ৩০ ডিগ্রির উপরস্থিত অঞ্চলে আসন্ন মাসে ক্রমবিনাশ পাবে। সম্ভবত উষ্ণ অঞ্চলের নিচের দিকে এই ভাইরাস সামান্য হলেও থেকে যাবে, এবং ঠান্ডা পড়লে ফের মাথা চাড়া দেবে। আরেকটা সম্ভাবনা হল উষ্ণ অঞ্চলে তথা দক্ষিণ গোলার্ধের গ্রীষ্ম এ ভাইরাস সইতে পারবে না, এবং নির্মূল হয়ে যাবে।”
অনুমানের সীমাবদ্ধতা
ওই গবেষণাতে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, মেঘ, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, ভ্রমণ, মিউটেশনের হার সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবলোকন করা হয়নি ও বিশ্লেষণ করা হয়নি।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিট্যুট অফ টেকনোলজির গবেষক কাসিম বুখারি এবং ইউসুফ জামিলের গবেষণাতেও তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার সঙ্গে ভাইরাস সংক্রমণের সম্পর্কের সীমাবদ্ধতার কথাই বলা হয়েছে।
তাঁদের গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ২২ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত প্রতি ১০ দিনের সংক্রমণে সর্বাপেক্ষা বেশি সংক্রমণ ঘটেছে ৪ থেকে ১৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় যেখানে আর্দ্রতার পরিমাণ ৩-৯ গ্রাম প্রতি কিউবিক মিটার।
তবে তাঁরা বলছেন সংক্রমণ ছড়ানো বিষয়টি টেস্টিং, সামাজিক চলমানতা ও সরকারি নীতির উপর নির্ভরশীল। “আমরা কোনওভাবেই বলতে চাইছি না, এই ভাইরাস উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ছড়াতে পারে না।”
এমআইটি-র গবেষণাপত্রেও দেখানো হয়েছে ইতালি, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউ ইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনের মত দেশ যেখানে ব্যাপক কোভিড ১৯ সংক্রমণ ঘটেছে, সেখানকার আবহাওয়া হুবেই বা উহানের মতই। তুলনামূলক বেশি উষ্ণ ও আর্দ্র এলাকা সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ায় বৃদ্ধির হার কম।
কারণ খুঁজতে গিয়ে
উষ্ণ এলাকায় কম সংক্রমণের বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণের কথা বলা হয়েছে এমআইটি-র গবেষণাপত্রে। “প্রথমত এর একমাত্র কারণ হতে পারে, বেশি স্বাস্থ্যজনিত সুবিধা সমৃদ্ধ দেশের চেয়ে এখানে পরীক্ষা কম হয়েছে, ফলে এসব জায়গায় সংক্রমণ ধরা পড়েনি... এখনও পর্যন্ত ঘনজনবসতিপূর্ণ উষ্ণ দেশগুলি (ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া)-তে টেস্টের পরিমাণ খুবই কম।”
গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, “দ্বিতীয়ত, চিনের সঙ্গে ইউরোপ ও আমেরিকার যাতায়াত অধিকতর, ফলে সে কারণেও সংক্রমণ এখানে বেশি হতে পারে। তবে চিনের সঙ্গে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলিতেও যাতায়াত খুবই বেশি, সেক্ষেত্রে এই দেশগুলিতে সংক্রমণ হার কম হওয়াটা বিস্ময়কর। মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার মত দেশে উন্নততর পরিকাঠামো নেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে চিনের সঙ্গে কম যোগাযোগ বা উন্নত চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাব দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাবে না।”
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, তৃতীয়ত এ কথাও বলা যেতে পারে যে এ দেশগুলিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে... যা আমরা সত্য নয় বলে জানি।
গবেষণায় উপসংহারে বলা হয়েছে, এসব জায়গায় সংক্রমণের হার কম হবার “প্রাকৃতিক কারণ থাকতে পারে, যা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।”
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন