সৌন্দর্য কিরণ-ছটা আমারও তো আছে! আছে কিংবা নেই, সেটা পরের কথা। কিন্তু সেই বার্তাই ঠিকরে বেরিয়ে আসছে মুখাবরণ থেকে। গোপনীয়তার মালিকানা লাভের অপ্রতিরোধ্য টানে আকর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে লম্ফ দিয়ে, তরতরিয়ে। ফলে, মহারারির দুঃখেও মাস্কের মহিমা মাথায় রাখতে হচ্ছে। এখানে রবীন্দ্রনাথকে ছোট্ট করে কোট করতে চাইছি। 'সর্বত্রই যে শোক-তাপ দুঃখ-যন্ত্রণা দেখিতেছি এ কথা অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু তবুও তো জগতের সঙ্গীত থামে নাই।' কোভিড-কালেও যে সে-সঙ্গীত থামেনি, তা মাস্ক হাড়ে-হাড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে। কী পুরুষ কী নারী মাস্কের মধ্য থেকে আরও ছটা-ধারী হয়ে উঠছে। কাব্যে লেখা রয়েছে, (যদিও ইতিহাসে নেই) মেবারের রাজা রতন সিংয়ের স্ত্রী পদ্মাবতীর সৌন্দর্যের খবরে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। তা মেবারের রাজধানী চিতোর এসে, দুর্গের সামনে বিরাট সেনা মোতায়েন করলেন তিনি। তার পর চিতোরদুর্গের ভিতরেও পৌঁছলেন আমন্ত্রণে, পদ্মাবতী-দর্শনই পাখির চোখ। দেখা মিলল, কিন্তু আয়নায় প্রতিফলিত মাত্র হলেন মহারানি। সে দেখা ছিটেফোঁটা। দর্পণে শরৎশশী। সেই অর্ধেক দেখাই সুলতানের উন্মাদনাকে চরমে তুলল। পদ্মাবতীকে অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে পেতে পুরো পাগল হয়ে গেলেন।
তা এ নিয়ে সিনেমাও হয়েছে। পদ্মাবত। ঝামেলাও হয়েছে বিস্তর। কিন্তু অধরা মাধুরী বা অর্ধেক দর্শন যে সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় শিহরণ তোলে সে ব্যাপারে কোনও দ্বন্দ্ব বা ধন্দ নেই কারওর। মুখ তাই মাস্কে ঢেকে নিজের আকর্ষণ যেমন বাড়ানো, তেমনই মহামারির বিরুদ্ধে মাস্কীয় অস্ত্র চালানো। টু-ইন ওয়ান প্রাপ্তি! তা, মহামারির এই মহাযুগে মাস্কের এই আকর্ষণ-কথা নতুন নয়, বেশ কিছু দিন ধরেই চলছে বাজারে, হটকেক--। তবে এ নিয়ে একটি গ্রাম্ভারি গবেষণা করে ফেলেছে ব্রিটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়। তার ফলাফলেও মাস্কে আকর্ষণ বৃদ্ধিই সামনে এসেছে। অনেকে অবশ্য এই শুনে রে-রে করে উঠবেন। তাঁরা হয়তো বলবেন, আরে মাস্কে শ্বাসকষ্ট বাড়ছে, মাস্ক পরতে ভুলে গেলে আত্মপীড়ন বাড়ছে, তাচ্ছিল্য করলে পুলিশের গুঁতো পড়ছে ইত্যাদি।
আসুন, এবার কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির গবেষণাটি কী বলছে, একটু দেখে নেওয়া যাক।
মাস্কীয় গবেষণা
গবেষকরা ৪০ জন পুরুষের মুখে নানা ধরনের মাস্ক বেঁধে আকর্ষণের দিকটি বিচার করেছেন। দেখেছেন, নির্দিষ্ট কিছু মাস্কে পুরুষের আকর্ষণ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে নীল রঙের সার্জিকাল মাস্ক। অন্য সব মাস্কের চাইতে এটিই নাকি পুরুষের প্রতি টান বাড়িয়ে তুলছে সব থেকে বেশি।
তা এই সিদ্ধান্তে কী করে তাঁরা পৌঁছলেন? নানা মাস্ক বেঁধে ছেলেদের হাজির করানো হয় মেয়েদের সামনে। মেয়েরা বিচার করে নম্বর দিয়েছেন। শুধু যে তাঁরা মাস্কেই হাজির হয়েছিলেন, তা নয়, নগ্ন মুখও দেখিয়েছিলেন । এ থেকে উঠে এসেছে এই 'সার্জিকালে সবচেয়ে আকর্ষণে'র সিদ্ধান্ত। এমনও জানানো হয়েছে যে, কিছু না পরা মুখের চেয়ে কাপড়ের মাস্ক পরা মুখের টানও বেশি।
স্যানিটারি মাস্ক, শুনলে বিরক্তি তৈরি হয়, তার বিরুদ্ধে এই ফলাফল যেন এক স্পর্ধা। যাতে ভাইরাসও চাপে পড়ছে। সবাই যদি আকর্ষণ বৃদ্ধির বিচারে এক নম্বর মাস্কটি মুখে পরে থাকেন, তা হলে সংক্রমণও তো ধাক্কা খাবে নাকি! ডা. মাইকেল লুইস, যিনি কিনা কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ সাইকোলজি-র শিক্ষক, প্রেস বিবৃতিতে বলেছেন, 'মহামারির আগেও এ নিয়ে গবেষণা হয়েছিল। তখন দেখা যায় মেডিক্যাল ফেস মাস্ক আকর্ষণ কমিয়ে দিচ্ছে। আমাদের জানার দরকার ছিল সেই ভাবনায় কোনও পরিবর্তন এসেছে কিনা। কারণ মাস্ক যে এখন সব সময়ের সঙ্গী।'
আরও পড়ুন কোভিডের দুটি ওষুধে ছাড়পত্র WHO-র, ওষুধ দুটি সম্পর্কে জানেন কি? পাবেন পাড়ার দোকানে?
অনেকে অবশ্য মনে করতেই পারেন, এ সব গবেষকদের নির্বিচারে সময় নষ্ট করা। কত কী করার আছে বাকি, বেলা বয়ে যায়… আর এঁরা এ সব করছেন! মহামারি কালে যখন ক্ষুধারাজ্যে ত্রাহি ত্রাহি ব্যাপার, ধনীর সম্পদ বাড়ছে, মধ্যবিত্তদের দল লাফিয়ে লাফিয়ে গরিবের দলে গিয়ে নাম লেখাচ্ছে, তখন দু'মুঠো তুলে দাও না বাবা মুখে, এ সব না করে--! বামপন্থীদের একাংশ তো বলতেই পারেন, চাঁদ মেঘে ঢাকল না কি ঢাকল না, তা নিয়ে না ভেবে একটা রুটির ব্যবস্থা করতে হবে, তাই তো আমরা ভল্যান্টিয়ার্স নামিয়েছি, এখন মাস্ক তো পরতেই হবে, কিন্তু মাস্ক-ভক্তি নয়, মার্ক্স-ভক্তি প্রয়োজন, কার্ল মার্ক্স একমাত্র খিদে মেটানোর দাওয়াইটা দিয়ে গিয়েছেন, তাই না!
কিন্তু যে যাই বলুন না কেন, মানুষ মাস্কে সুন্দর-- গবেষণা-বার্তাটা হেলাফেলার নয়। জীবনের চলতি পথের নানা পরিবর্তন মনস্তত্ত্বের উপর কী প্রভাব ফেলে, সে একটা বিরাট ব্যাপার, তা নিয়ে গবেষণা চলে, চলবেও, মাস্ক কেন বাদ যাবে-বা। তাই, খুঁত না ধরে গবেষকদের মাস্কীয় মানচিত্রটা পড়ার চেষ্টা করা উচিত মন দিয়ে, এবং মাস্ক পরে নিজের আকর্ষণ এবং ভাইরাসের বিকর্ষণ বাড়ানো উচিত একশো শতাংশ।