(মুম্বইয়ের ইন্ডিয়ান কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস-এর ডিন, এনডোক্রিনোলজিস্ট ডক্টর শশাঙ্ক জোশী কথা বললেন অনুরাধা মাসকারেনহাসের সঙ্গে।)
নভেল করোনাভাইরাস রোগ ক্রমশ ছড়াচ্ছে, কেবলমাত্র অতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেই হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মুম্বইয়ের মত বেশ কিছু শহরে হাসপাতালে বেডের সংকুলান হচ্ছে না। এ সমস্যা আগামীদিনে আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা। এই পরিস্থিতিতে যাঁদের জরুরি চিকিৎসা পরিষেবার প্রয়োজন নেই, তেমন সংক্রমিতদের বাড়িতে থেকেই সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। কিন্তু বাড়িতে থেকে সুস্থ হওয়ার অর্থ এই নয় যে কেবল বাড়িতে থেকে ১৪ দিনের কোয়ারান্টিনের সময়টুকু পার করে দেওয়া।
হোম কোয়ারান্টিনে থাকার সময়ে কিছু ভাল প্র্যাকটিস সুস্থতা প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে, একই সঙ্গে পরিবারের অন্যদের সুরক্ষাও দিতে পারে। যথাযথ খাবার খাওয়া, ৮ ঘন্টা ঘুম, যথেষ্ট জল পান এবং ইতিবাচক মনোভাব সুস্থতা আনতে সাহায্য করতে পারে।
দীর্ঘতর কোয়ারান্টিন
বাড়িতে হোক বা প্রতিষ্ঠানে, সংক্রমিত ব্যক্তিদের ১৪ দিনের কোয়ারান্টিনে থাকা সাধারণ নিয়ম হলেও রোগীরা যদি কোয়ারান্টিনে আরেকটু বেশি সময় কাটান তাহলে আরোগ্যলাভের পক্ষে ভাল। আমার মতে ২৮ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারান্টিনের ব্যবস্থা করা আদর্শ হত, এতে শুধু আরোগ্যের দিক থেকেই ভাল হত তা নয়, পরিবার, কেয়ারগিভার এবং কমিউনিটির পক্ষেও তা সাধারণভাবে বেশি ভাল হত। বাড়িতে কোয়ারান্টিনের মেয়াদ বাডা়নো সম্ভব। এমনকি যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টিনে রয়েথেন, তাঁদের ছাড়া পাওয়ায়র পর বাড়িতেও ওই একই পদ্ধতি মেনে নিজেদের কোয়ারান্টিনের মেয়াদ বাড়ানো উচিত।
যাঁদের ঝুঁকি বেশি, যেমন ৫৫ বছরের বেশি বয়সী, বা যাঁদের হাইপারটেনশন, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, ক্রনিক সিওপিডি, লিভার বা কিডনির অসুখ রয়েছে, বা যাঁরা ইমিউনোসাপ্রেস্যান্ট বা স্টেরয়েড নেন, তাঁজের অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত নিয়ে চিকিৎসা করতে হবে।
যেসব ওষুধ নিয়ে কোভিডের সঙ্গে লড়াই করছে ভারত
এ ধরনের রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশনের মাত্রা ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ সবথেকে জরুরি। বাস্তবত, অন্য সব রোগীদের ক্ষেত্রেও অক্সিজেন স্যাচুরেশনের মাত্রার দিকে লক্ষ্য রাখা সাধারণ নিয়ম করা উচিত। যদি তা ৯২ শতাংশের নিচে নেমে যায় এবং রোগী যদি শ্বাসকষ্টের অভিযোগ করেন, তাহলে তা বিপদসংকেত হিসেবে দেখে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন যে কোনও কিছুই করা উচিত। মুখ ও বুক নিচের দিকে রেখে ঘুমোলে রোগীর উপকার হবে। বর্ষা আসছে, এ সময়ে ফাস্ট ফুড ও আইসক্রিম না খাওয়াই ভাল, কারণ এ থেকে গলা ব্যথা হতে পারে। মদ্যপানের মাত্রাও সীমিত রাখা উচিত। বেশি পরিমাণ মদ্যপানের ফলে প্রতিরোধক্ষমতা কমে। যোগব্যয়াম ও সাধারণ শারীরিক ব্যয়াম কার্যকর হতে পারে।
যাঁদের ইসিজি স্বাভাবিক, তাঁদের হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিনের পাঁচ দিনের কোর্স করার কথা বলা যেতে পারে, সঙ্গে ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি ও জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট চলবে। যাঁরা অলটারনেটিভ মেডিসিনে প্রত্যয়ী, তাঁদের আয়ুর্বেদ বা হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। তবে যাঁরা ঝুঁকিপ্রবণ, অন্য অসুস্থতা রয়েছে, বা যাঁদের রোগের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে তাঁরা এই পদ্ধতি এড়িয়ে গেলেই ভাল।
পরিবার ও কেয়ারগিভার
সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে যেসব কেয়ারগিভার বা পরিবারের সদস্যরা আসবেন, তাঁদের নিজেদের সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি, যাতে তাঁরা নিজেরা সংক্রমিত না হয়ে পড়েন। এঁদের সকলেই আইসিএমআর প্রটোকল মেনে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তিনসপ্তাহ ধরে সপ্তাহে একদিন হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেতে পারেন। প্রতিষেধক ওষুধ হিসেবে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন যথেষ্ট ভাল এবং যাঁরা কোভিড ১৯ রোগীদের হাসপাতালে দেখভাল করছেন, তাঁদের এ ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হয়েছে।
হাইপারটেনশনের কোভিড রোগীদের মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি
একটা কথা মনে রাখা জরুরি যে উপসর্গবিহীন রোগীরাও একইভাবে ভাইরাস ছড়াতে পারেন, ফলে তাঁদের পরিবারের সদস্য ও কেয়ারগিভারদের কঠোর সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে চলতে হবে। রোগীরা যে থালাবাসনে খাচ্ছেন, তা পরিবারের অন্যদের পক্ষে ব্যবহার না করাই ভাল। সবচেয়ে ভাল হয় রোগীকে ডিসপোজেবল বাসনে খাবার পরিবেশন করলে।
সাধারণত দশম দিনের পর ভাইরাস রোগীর দেহে নিজেদের বিস্তার বন্ধ করে দেয়, এবং ততদিন পর্যন্ত সহজে সংক্রমণ হতে পারে। সে কারণেই অনেকক্ষেত্রে রোগীদের ১০ দিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে বিপদ সঙ্গে সঙ্গে কাটে না। হোম কোয়ারান্টিনে যাঁরা থেকেছেন বা থাকছেন তাঁদের সংক্রমণের দ্বিতায় সপ্তাহ পর্যন্ত রুটিন চেকআপ করানো উটিত। যদি অক্সিজেন মাত্রায় অস্বাভাবিক তারতম্য দেখা যায় বা অন্য কোনও বিপদসংকেত দেখা যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ভয় পাওয়ার কিছু নেই
অক্সিজেন মাত্রা নজর রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাজারে যে পালস অক্সিমিটার পাওয়া যায়, তাতেই কাজ চলবে। এর মাধ্যমে রোগ ধরা পড়ার পর থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন পরীক্ষা করতে হবে। ৬ মিনিট দ্রুতপায়ে হাঁটার পর এই পরীক্ষা করা সবচেয়ে ভাল। যদি হাঁটার পর অক্সিজেন মাত্রা ৯২ শতাংশের নিচে নেমে যায় তাহলে রোগীকে ভেন্টিলেশন সুবিধা রয়েছে এমন হাসপাতালে ভর্তির বন্দোবস্ত করা উচিত।
এ একটা অতি স্মার্ট ভাইরাস, কিন্তু কার্যকরী উপায়ে এর মোকাবিলাও করা সম্ভব, যতদিন না পর্যন্ত কোনও চিকিৎসা বা ভ্যাকসিন বেরোয়। ততদিন আমাদের এর সঙ্গে বাঁচতে শিখতে হবে। ভয় পাওয়া বা উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। প্রায় সব ক্ষেত্রেই রোগীকে আইসোলেশন ও কোয়ারান্টিনে থাকা এবং সামান্য অসুস্থ হওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। তবে মানসিক ও হার্দিক স্বাস্থ্য দ্রুত আরোগ্যের অন্যতম উপায়। ফলে ভয় ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতে হবে।