Advertisment

কোভিড ১৯ মোকাবিলা- কেরালার রাস্তা

২০১৯ সালের জুন মাসে কেরালা নীতি আয়োগের তৈরি করা স্বাস্থ্য সূচকের শীর্ষে ছিল ৭৪.০১ পয়েন্ট নিয়ে, যা তালিকার একেবারে শেষে থাকা উত্তর প্রদেশের (২৮.৬১) -এর তুলনায় আড়াইগুণ বেশি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Covid 19, Kerala Robust healthcare

২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১২টি দেশে সার্ভে করে দেখে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার চল কেরালায় ৩৪ শতাংশ, যা সার্ভের অন্য সমস্ত জায়গার তুলনায় সর্বাধিক

৩০ জানুয়ারি ভারতের কেরালায় প্রথম কোভিড ১৯ সংক্রমণের ঘটনা ধরা পড়ে, ২৩ বছরের এক মেডিক্যাল ছাত্রের শরীরে। তিনি উহান থেকে ফিরেছিলেন। চিনে ভ্রমণের ইতিহাস সম্বলিত ৮০০ জনকে কেরালায় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এখনও পর্যন্ত কেরালায় ৪৩৭ জনের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, তাঁদের মধ্যে ৩০৮ জন সুস্থ হয়েছেন,২ জন মারা গিয়েছেন। ৭০ শতাংশ সুস্থতার হার নিয়ে তারা দেশের শীর্ষে। কেরালায় মোট ২০,৮২১ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, যা সমস্ত রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

Advertisment

জনস্বাস্থ্যের ধারা

১৯৫৬ সালে কেরালা পৃথক রাজ্য হবার আগে থেকেই এ অঞ্চলে জনস্বাস্থ্য নিয়ে প্রভূত কাজ হয়েছে। ১৮৭৯ সালে পূর্বতন ত্রিবাঙ্কুরের শাসকরা সরকারি কর্মী, জেলবন্দি ও ছাত্রদের জন্য প্রতিষেধক নেওয়া আবশ্যিক বলে ঘোষণা করেন।

১৯২৮ সালে রকফেলার ফাউন্ডেশন হুকওযার্ম ও ফাইলারিয়াসিস নিয়ন্ত্রণে প্যারাসাইট সার্ভে করে।

গোষ্ঠী স্বাস্থ্যের এই বহমানতা পরে রাজ্যে সাক্ষরতা ও মহিলাদের শিক্ষায় নজর দেবার ফলে আরও বৃদ্ধি পায় এবং তার জেরে ভ্যাকসিনেশন প্রায় ১০০ শতাংশে পৌঁছয় ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টিতে জোর পড়ে।

এক সপ্তাহে গুজরাটে সংক্রমণ বাড়ল তিনগুণ, প্রায় তিনগুণ বাড়ল মৃত্যুও  

২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১২টি দেশে সার্ভে করে দেখে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার চল কেরালায় ৩৪ শতাংশ, যা সার্ভের অন্য সমস্ত জায়গার তুলনায় সর্বাধিক। ফলে কোভিড-১৯ প্রকোপের সময়ে ব্রেক দ্য চেন কর্মসূচি যখন সে রাজ্যে শুরু হয়, তা ছিল পুরনো অভ্যাসকেই ফের মনে করানো।

  স্বাস্থ্য পরিকাঠামো

কেরালায় কোভিড ১৯ মোকাবিলায় অন্যতম বড় অস্ত্র ছিল সে রাজ্যের শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যা অনেক উন্নত দেশের সমতুল্য। ২০১৯ সালের জুন মাসে কেরালা নীতি আয়োগের তৈরি করা স্বাস্থ্য সূচকের শীর্ষে ছিল ৭৪.০১ পয়েন্ট নিয়ে, যা তালিকার একেবারে শেষে থাকা উত্তর প্রদেশের (২৮.৬১) -এর তুলনায় আড়াইগুণ বেশি।

যদিও কেরালা তাদের বাজেটের মাত্র ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয় করে, যা এ ক্ষেত্রে জাতীয় ব্যয়ের প্রায় সমান, তা সত্ত্বেও তাদের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নজরদারির ফলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র যথেষ্ট ভাল জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এই কেন্দ্রগুলির পরিচালনায় থাকে ত্রিস্তরীয় আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ. যাদের অনেকেরই আধুনিক ডায়াগনোস্টিক সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে টেলি মেডিসিন পরিষেবাও।

রাজ্যের বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা একসময়ে ছিল মূলত খ্রিষ্টিয় গির্জার হাতে। গত দুদশকে এই ক্ষেত্রের ব্যাপক বৃদ্ধি পয়েছে, সৌজন্যে এনআরআই এবং কর্পোরেট স্বাস্থ্য গোষ্ঠীগুলি। বর্তমানে কেরালায় ১,৪২,৯২৪টি শয্যা রয়েছে হাসপাতালগুলিতে, যার মধ্যে বেসরকারি ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৯৩,০৪২।

কোভিড নিয়ন্ত্রণে কেরালার কাসারাগড় কীভাবে মডেল হয়ে উঠল?

সামনের সারিতে জোর

১ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের করোনাভাইরাস কন্ট্রোল সেল টেস্টিং, কোয়ারান্টিন, হাসপাতালে ভর্তি ও হাসপাতাল থেকে ছাড়ার নিয়মাবলী নিয়ে গাইডলাইন প্রকাশ করে, যা নিয়মতিভাবে আপডেট করা হয়।

জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত রাজ্যে টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না, এবং সমস্ত সোয়াব পাঠানো হচ্ছিল পুনের ন্যাশনাল ইনস্টিট্যুট অফ ভাইরোলজিতে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আলাপ্পুজার এনআইভি এি পরীক্ষার ছাড়পত্র পায়। গত দু মাসে কেরালায় কোভিড ১৯ পরীক্ষার ১৩টি কেন্দ্র তৈরি হয়েছে, যার ১০টি সরকারি।

রাজ্য তাদের চিকিৎসা পরিকাঠামোতেও উন্নতি ঘটিয়েছে, কার্যকর নয় এমন হাসপাতালগুলিকে কোভিড-১৯ পরিকাঠামোয় রূপান্তরিত করেছে। এখনও পর্যন্ত ৩৮টি সরকারি হাসপাতালকে কোভিড ১৯ হাসপাতালে পরিণত করা হয়েছে, সরকার হাসপাতালে ৮০০ ভেন্টিলেটর বসানো হয়েছে এবং ১৫৭৮টি বেসরকারি হাসপাতালকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

 নিপা থেকে শিক্ষা

 মূলত আইসিএমআরের প্রোটোকল মেনে চলে কেরালা ব্যাপক নজরদারি চালু রেখেছে, ২০১৮-১৯ সালে নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়কার পদ্ধতিকেই আরও সূক্ষ্মস্তরে কাজে লাগানো হয়েছে। সংস্পর্শ চিহ্নিতকরণ ছাড়াও, কেরালা ২৮ দিনের হোম কোয়ারান্টিন বলবৎ রেখেছে যদিও ভাইরাসের সাধারণ ইনকিউবেশনের সময়কাল ১৪ দিন।

মার্চের শুরু থেকে সমস্ত আন্তর্জাতিক যাত্রীদের স্ক্রিনিং করা হয়েছে। যদি কেউ বাদ গিয়ে থাকেন, তাঁদের গ্রাম কমিটির মুখে পড়তে হয়েছে, যাঁরা নতুন আগতদের সম্পর্কে স্বাস্থ্য দফতরকে জানিয়েছেন এবং এঁদের ঘরের ভিতরে থাকা সুনিশ্চিত করেছেন।

কাসারাগড় ও কান্নুরের মত হটস্পট জেলাগুলির কিছু পঞ্চায়েত কল সেন্টার খুলে কোয়ারান্টিনে থাকা মানুষদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন।

কীভাবে সার্স কোভ ২-এর নমুনা সংগ্রহ, প্রেরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে?

এ ছাড়া পজিটিভ কেসের রুট ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে জিপিএসের মাধ্যমে, যাতে ওই রুট দিয়ে যাঁরা যাতায়াত করেছেন তাঁরা সংস্পর্শে এসেছেন এই আশঙ্কায় নিজেরাই রিপোর্ট করতে পারেন। এর ফলে ক্লাস্টার পরিচালনা সহজতর হয়েছে।

বিমান চলাচল বন্ধ হবার পর রাজ্য নজর দেয় আন্তঃরাজ্য সড়ক ও ট্রেন যাত্রীদের উপর। যাঁরা ৮ মার্চের পর কেরালায় পৌঁছেছেন এবং তাঁদের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের আইসোলেশনে যেতে বলা হয়েছে। এর ফলে দিল্লির তাবলিঘি জামাতের অংশগ্রহণকারীদের থেকে সংক্রমণ আটকানো গিয়েছে।

অন্য বেশ কিছু রাজ্যে যখন তবলিঘিদের পরীক্ষা শুরু হয়েছে, সে সময়ে কেরালা এরকম ২১৭জনকে পর্যবেক্ষণের আওতায় রেখেছে। এঁদের মধ্যে ২০ জন পজিটিভও এসেছেন।

সামাজিক, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ

কেরালার দ্বিমুখী রাজনৈতিক চলন সত্ত্বেও প্রায় গোটা রাজ্যই মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের দৈনিক সাংবাদিক সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেখানে তিনি কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হচ্ছে, তার বর্ণনা করে থাকেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী শৈলজা দৈনিক বৈঠক করেন জেলা মেডিক্যাল অফিসারদের সঙ্গে, মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে পুলিশ, রাজস্ব, বিদ্যুৎ ইত্যাদি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ের কাজ করা হয়। প্রতিদিন সন্ধেয় মুখ্যমন্ত্রী রিভিউ মিটিং করেন এবং অন্যদের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত থাকেন কোভিড ১৯ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান ডক্টর বি ইকবাল।

রাজ্যের দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্প কুদুম্বশ্রী মিশন মাস্ক তৈরি ও কমিউনিটি কিচেনের স্বেচ্ছাসেবক সরবরাহের বিষয়ে সামনের সারিতে রয়েছে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

kerala coronavirus COVID-19
Advertisment