ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (ICMR) সম্প্রতি দুটি সংস্থার তৈরি করা কোভিড ১৯ পরীক্ষার জন্য তৈরি এলিজা কিট অনুমোদন করেছে। আইসিএমআরের নিজের প্রযুক্তিতে তৈরি এলিজা কিট ছাড়া এই প্রথম অন্য কোনও এলিজা কিট অনুমোদিত হল। এর ফলে কোভিড-১৯ পরীক্ষার পদ্ধতিতে আরও সুযোগ বাড়ল। একবার দেখে নেওয়া যাক কী কী ভাবে পরীক্ষা করা যেতে পারে।
এলিজা
১৯৭৪ সালে তৈরি হওয়া এলিজা পদ্ধতির মাধ্যমে কোনও ব্যক্তির শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় কোনও নির্দিষ্ট সংক্রমণের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা তা ধরা পড়ে।
এ পরীক্ষায় এনজাইমের মাধ্যমে রক্তের নমুনায় অ্যান্টিবডির উপস্থিতি ধরা পড়ে। এলিজা টেস্ট দু ধরনের অ্যান্টিবডির উপর নির্ভর করে- ইমিউনোগ্লোবুলিন জি (IgG) এবং ইমিউনোগ্লোবুলিন এম (IgM)। IgG-র মাধ্যমে সংক্রমণের পরবর্তী পর্যায়ে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি নির্ধারিত হয়, IgM-এর মাধ্যমে সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির হদিশ মেলে বলে জানালেন সায়ন হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজিস্ট সুজাতা বাভেজা।
ভারতে কোভিড-১৯-এর এলিজা টেস্ট সেরোসার্ভের জন্যই কেবলমাত্র অনুমোদিত - যা উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা এবং কনটেনমেন্ট জোনে, যাঁদের প্রতিরোধক্ষমতা কম এমন ব্যক্তিদের এবং সামনের সারির কর্মী স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে করা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন, বর্ষাকালে করোনাভাইরাসের আচরণ
মে মাসে আইসিএমআর ন্যাশনাল ইন্সটিট্যুট অফ ভাইরোলজির মাধ্যমে কোভিড কবচ এলিজা IgG টেস্ট ডিজাইন করে। এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সাতটি সংস্থা এই কিট তৈরি করে। সংস্থাগুলি হল Zydus Cadila, Meril Diagnostics, Voxtur Bio,
এ মাসের গোড়ায় আইসিএমআর কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য Transasia Bio Medicals ও Euroimmun US Inc-কে এলিজা কিট তৈরির অনুমতি দিয়েছে। Transasia-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুরেশ ভাজিরানি বলেছেন তাণরা এক মাসে তিন কোটি কিট বানাতে সক্ষম।
আরটি-পিসিআর
এলিজা টেস্টের খরচ কম এবং পরীক্ষা দ্রুত হয়, তবে এর ব্যবহার মূলত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ যার মাধ্যমে পলিসিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। ব্যক্তিগত ডায়াগনোসিস ও কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য সারা পৃথিবীতে RT-PCR (real time-polymerase chain reaction) পরীক্ষা করা হয়। এর আগে ইবোলা ও জিকার ডায়াগনোসিসের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে।
ভারতে RT-PCR-ই কোভিড-১৯ সংক্রমণের চূড়ান্ত নিশ্চিত পরীক্ষা। এখানে নাক ও মুখের থেকে লালারস সংগ্রহ করে তা থেকে ভাইরাল আরএনএ নিষ্কাশন করে তা থেকে সার্স কোভ ২ ভাইরাস চিহ্নিত করা হয়।
এটি ব্যয়বহুল পরীক্ষা হলেও সরকারি ল্যাবরেটরিতে বিনামূল্যে করা হয়ে থাকে। মে মাসের শেষ দিক পর্যন্ত এই পরীক্ষার মূল্য বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে ৪৫০০ টাকা বেঁধে দেওয়া ছিল, কিন্তু তার পর থেকে ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন রাজ্যগুলি এই পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ করছে।
বিভিন্ন সংস্থার তৈরি ৯৭টি কিট পরীক্ষা করে আইসিএমআর ৪০টি কিট এখনও পর্যন্ত অনুমোদন করেছে। নাক বা মুখের লালারস ছাড়াও RT-PCR পরীক্ষায় ব্রঙ্কোয়ালভেলার ল্যাভেজ পদ্ধতির ব্যবস্থাও রয়েছে যার মাধ্যমে ফুসফুস বা থুথু থেকে রস সংগৃহীত হয়ে থাকে। এতে ভাইরাল লোড বেশি হওয়ায় ভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।
র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট
এ পরীক্ষায় সময় লাগে বড়জোর ২০-৩০ মিনিট। সবচেয়ে সস্তা এই টেস্টে রক্তে অ্যান্টিবডির হদিশ করা হয়। কিন্তু এই পরীক্ষায় ভুল ফলের ঝুঁকি ব্যাপক - এখানে অন্য কোনও সংক্রমণের অ্যান্টিবডি চিহ্নিত হতে পারে এবং তা কোভিড-১৯ সংক্রমণ বলে চিহ্নিত হয়ে যেতে পারে। ফলে জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমীক্ষার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। যদি কোনও ব্যক্তি র্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে পজিটিভ হন, তাহলে তাঁর চিকিৎসা শুরুর আগে RT-PCR পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এলিজা বরং এর থেকে বেশি নিখুঁত।
আরও পড়ুন, আনলকিংয়ের দু সপ্তাহ পার, এখনও মানুষের আত্মবিশ্বাস ফেরেনি
এই পরীক্ষায় আঙুল থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে একটি টেমপ্লেটে ফেলা হয়। এ পরীক্ষার খরচ ৬০০ টাকা। রক্তের বদলে প্লাজমা বা সিরামও ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই পরীক্ষার জন্য আইসিএমআর এখনও পর্যন্ত ৪৬টি টেস্টিং কিট পরীক্ষা করে ১৪টির অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্যে ১১টির প্রস্তুত কারক ভারতীয় সংস্থা।
ট্রুন্যাট
আরটি পিসিআরের মতই এই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিট আকারে ছোট হয় এবং ফল আসে দ্রুততর। গোয়ার মলবায়ো ডায়াগনোস্টিকস প্রাইভেট লিমিটেডের ডিজাইন করা এই কিট মূলত যক্ষ্ণা ও এইচআইভি পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি আইসিএমআর কোভিড-১৯ পরীক্ষা ও নিশ্চয়তার জন্য ট্রুন্যাট অনুমোদন করেছে। যদি এতে নমুনা নেগেটিভ হয়, তাহলে তা নেগেটিভ হিসেবেই গণ্য, কিন্তু যদি পজিটিভ হয় তাহলে ফের অন্য একটি পরীক্ষা করা হবে।
ট্রুন্যাট মেশিন ছোট ও বহনক্ষম, মূলত ব্যাটারিতে চলে এবং ফল দেয় এক ঘণ্টার মধ্যে। এ পরীক্ষার জন্য নাক বা মুখের লালারসের প্রয়োজন হয়। ভারতে যক্ষ্ণা পরীক্ষার জন্য ৮০০ মেশিন রয়েছে ফলে সরকারকে এ মেশিনের পিছনে আর খরচ করতে হবে না।
কখন কোন টেস্ট
কোনও ব্যক্তি সংক্রমণের বিভিন্ন পর্যায়ে এই পরীক্ষায় পজিটিভ আসতে পারেন। কোনও ব্যক্তি এক্সপোজড হওয়ার পর তাঁর শ্বাসনালীতে কয়েকদিন ভাইরাল লোড বেশি থাকে, ফলে আরটি পিসিআর বা ট্রুন্যাট পরীক্ষায় পজিটিভ আসতে পারে। কিন্তু তাঁর শরীরে যগি অ্যান্টিবডি তৈরি না হয়ে থাকে, তাহলে র্যাপিড টেস্ট ও এলিজা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসতে পারে। এক সপ্তাহের বেশি সময় পরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে, যখন আরটি-পিসিআর পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসতে পারে কিন্তু এলিজা ও র্যাপিড টেস্টে পজিটিভ ফল আসবে।
ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসার জন্য ডাক্তাররা আরটি-পিসিআর পরীক্ষার উপর নির্ভর করেন। একবার নিশ্চিত হওয়ার পর রোগীকে আলাদা করা হয় এবং উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসা শুরু হয়।
এলিজা বা র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টে পজিটিভ রেজাল্টের অর্থ এই নয় , ওই ব্যক্তি সংক্রমিত বা তাঁর আইসোলেশনে যাওয়া প্রয়োজন- এর অর্থ হতে পারে ওই ব্যক্তি ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছেন এবং তাঁর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এই দুটি পরীক্ষা সস্তা হওয়ায় বড়মাপের জনসংখ্যায় সংক্রমণের নমুনার জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে সংক্রমণ কতটা ছড়িয়েছে তাই দেখা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন মহারাষ্ট্রের হেলথ সার্ভিস ডিরেক্টরেটের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর ডক্টর অর্চনা পাটিল।