বলের রং গোলাপি কেন, ভারত কেন দেরিতে গোলাপি বলে খেলা শুরু করল এবং মীমাংসার জন্য গোলাপি বল কেন জরুরি?
২২ নভেম্বর শুক্রবার থেকে ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে গেল। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ইডেন গার্ডেন্সে প্রথম গোলাপি বলের টেস্টে বাংলাদেশ টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতের বোলিং শক্তি এবং ভারতের মাঠের পরিবেশ ও আবহাওয়ার কারণে, বিশেষ করে রিভার্স সুইং এবং স্পিনের ব্যাপারে গোলাপি বল কতটা কার্যকর, এসব সংশয়ের কারণে বিসিসিআই দিন রাতের টেস্ট নিয়ে অনাগ্রহী ছিল।
ভারতীয় বোর্ড ২০১৮-১৯ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে অ্যাডিলেডে দিন-রাতের টেস্ট খেলতে রাজি হয়নি। ভারত মনে করেছিল লাল বলের পরিচিত বিশ্ব ছেড়ে পরীক্ষামূলক এবং অনিশ্চিত বলে এতদিনের পরিচিত ফেভারিট মাঠে খেলা ঠিক হবে না।
আরও পড়ুন, গোলাপি বলের খুঁটিনাটি, বিশেষজ্ঞের মতামত, দেখুন ভিডিও
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার গোলাপি বলে খেলার রেকর্ড পাঁচ ম্যাচের পাঁচটিতেই বিজয়ী। সেটাও একটা কারণ হতে পারে ভারতের আপত্তির। (ওই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার রেকর্ড ছিল ৪-এ ৪। এ বছর গাব্বায় দিন রাতের টেস্ট ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ইনিংস ও ৪০ রানে হারায় তারা।)
ভারতে এর আগে ২০১৬ সালে দলীপ ট্রফির একটি ম্যাচে গোলাপি বলে খেলা হয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সহ একাধিক প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটারদের প্রস্তাব মানেনি তারা।
সৌরভ বিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। প্রথম গোলাপি বলের টেস্ট খেলা হচ্ছে তাঁর ঘরের মাঠে।
বলের রং গোলাপি হল কেন?
বলের রং প্রথমে হলুদ এবং তারপর কমলা করার একটা চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু ঘাসের উপর বল দেখতে পাওয়ার ব্যাপারে এবং উঁচু ক্যাচ নেবার জন্য গোলাপি রংই যে সেরা সে ব্যাপারে সকলে সহমত হন। তবে ব্যাটসম্যানদের অভিযোগ পিচের ধূসর রঙের সঙ্গে এ রং কখনও কখনও মিশে যায়।
বল প্রস্তুতকারী সংস্থা কোকাবুরা শুরুতে দিন রাতের টেস্টের জন্য বলের সেলাইয়ের রং রাখত গাঢ় সবুজ। তারপর তারা সেলাইয়ের রং সাদা করতে শুরু করে। প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ এবং তাঁর সময়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অন্য খেলোয়াড়রাদের পরামর্শে সিমের রং করা হয় কালো। এই খেলোয়াড়দের বক্তব্য ছিল বলের সিমকেও দৃশ্যমান হতে হবে।
আরও পড়ুন, ইডেনে দিনরাতের টেস্ট: সন্ধের মুখে বেশি সুইং করবে গোলাপি বল
পৃথিবীর প্রথম গোলাপি বলের টেস্ট খেলা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের, ২০১৫ সালের নভেম্বরে। অ্যাডিলেডের মাঠে অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ৩ উইকেটে।
সাদা বল যেভাবে বানানো হয়, গোলাপি বল কি তার চেয়ে অন্যভাবে প্রস্তুত করা হয়?
ঠিক তা নয়। লাল, সাদা, গোলাপি- সব ক্রিকেট বলই তৈরি হয় কর্ক, রবার, উলের সুতো দিয়ে, এবং একই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় সব ক্ষেত্রেই। ফারাকটা হয় ফিনিশিংয়ে।
লাল ক্রিকেট বল গ্রিজে ডুবিয়ে নেওয়া হয় যাতে চামড়ায় জল না ঢুকতে পারে। কিন্তু গোলাপি বলের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয় কারণ তাহলে গোলাপি ফ্লুরোসেন্ট রং আবছা হয়ে যাবে, কৃত্রিম আলোয় বল দেখতে সমস্যা হবে।
দিন-রাতের বলে পিগমেন্ট ফিনিশ দেওয়া হয়ে থাকে। গোলাপি রঙের মোটা আস্তণ দেওয়া হয় স্প্রে করে যাতে বেশি সময় ধরে তা উজ্জ্বল থাকে, যাতে বল দেখতে ফিল্ডারদের, ব্যাটসম্যানদের, গ্যালারিতে থাকা ক্রিকেটপ্রেমীদের এবং টেলিভিশন দর্শকদের সমস্যা না হয়।
কিন্তু এর ফলে বলের গোলাপি রং পুরনো হলেও ঔজ্জ্বল্য হারায় না, ফলে টেস্ট ম্যাচের একটা মজা হারিয়ে যায়।
ভারতীয় শিবিরের আরেকটা উদ্বেগের বিষয় হল বলের উপর অতিরিক্ত পালিশ- যার ফলে ম্যাচ গড়ালেও রং থাকবে বটে কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আলোর নিচে তা গোলাপির থেকে বেশি কমলা দেখাবে।
গোলাপি বল তার মানে আসলে ছদ্মবেশী সাদা বল?
এর উত্তর একইসঙ্গে হ্যাঁ এবং না। সাদা বলের মতই গোলাপি বলও ফ্ল্যাট হয়ে যায়।
লাল বলের চেয়ে হালকা হবার ফলে গোড়ার দিকের ওভারগুলোতে বল সুইং বেশি করে। সিম মুভমেন্টও ২০ শতাংশ বেশি হয়।
তবে বল নরম হয়ে গেলে সুইং আর হয় না। পেসাররা রিভার্স সুইং পেতে অসুবিধায় পড়েন, স্পিনারদের অভিযোগ, বল ঘোরে না। এর ফলে দীর্ঘ সময় ধরে খেলায় কোনও উত্তেজনা থাকে না।
ভারতের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হল, পুরনো বল রিভার্স সুইং করে না, ফলে মহম্মদ শামি, উমেশ যাদব, জসপ্রীত বুমরা এবং ভুবনেশ্বর কুমারের মত ভারতীয় বোলাররা ভোঁতা হয়ে পড়েন। (বুমরা এবং ভুবনেশ্বর কুমার বর্তমান দলে যদিও নেই)
টেস্ট ম্যাচ হঠাৎ সন্ধেবেলা কেন?
গত দশকের শেষ দিকে এই ভাবনার উদয় হয়। টেস্টের দর্শক কমে যাওয়ার কারণেই এই ভাবনা।
একটা যুক্তি ছিল, ওয়ান ডে এবং টি ২০ ম্যাচ সন্ধেয় হবার কারণে মাঠে এবং টিভির সামনে বেশি লোক হচ্ছে, টেস্টের ক্ষেত্রেও তাই হবে। যুক্তিটা আরও বেশি সবল হয়ে ওঠে যেেহতু সপ্তাহের কাজের দিনে পাঁচদিনের টেস্টের একটা অংশ রাখতেই হবে।
আরেকটা যুক্তি হল দিন রাতের টেস্ট ম্যাচে মীমাংসার পরিমাণ বেশি।
এটা ঘটনা যে এখনও পর্যন্ত খেলা ১১টি দিন রাতের ম্যাচের প্রত্যেকটিরই মীমাংসা হয়েছে, এবং জেতার ব্যাপারে বড় ভূমিকা নিয়েছে কন্ডিশন।
অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বোলাররা ভাল করলেও (২০১৭-র ডিসেম্বরে একটা ম্যাচে ইংল্যান্ড ৫৮ রানে অল আউট হয়ে গিয়েছিল), ব্যাটিং মাইলস্টোনও কম হয়নি। ২০১৬ সালে দুবাইতে আজহার আলি তিনশ রান করেন এবং এজবাস্টনে অ্যালিস্টেয়ার কুক ২৪৩ রান করেন।
এশিয়ার পিচে স্পিনাররা বেশি সফল হয়েছেন- দেবেন্দ্র বিশু দুবাইতে ৪৯ রানে ৮ উইকেট নিয়েছেন, সেটাই এখনও পর্যন্ত সেরা ফিগার। তবে দক্ষিণ গোলার্ধে দিন রাতের ম্যাচে পেসাররাই বেশি ভাল করেছেন।
দিন রাতের টেস্ট সবচেয়ে বেশি উত্তেজক হয়ে ওঠে গোধূলির সময়ে। যখন সূর্য পুরোপুরি অস্ত যায় না এবং ফ্লাডলাইটের কিছু আলো জ্বলে ওঠে। স্বাভাবিক আলো ও কৃত্রিম আলো যখন মিশে যায়, তখন গোলাপি বল দেখতে সমস্যায় পড়েন ব্যাটসম্যানরা। একই সঙ্গে তাপমাত্রা কমতে থাকায় এবং বাতাসের আর্দ্রতার কারণে বলও সুইং করতে শুরু করে।