আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ফৌজকে সম্পূর্ণ ভাবে সরানোর পদক্ষেপই কাল হল। তালিবানের তড়িৎগতি দেখা গেল। জঙ্গিদের পূর্ণগ্রাসে চলে এল আফগানিস্তান। হ্যাঁ, এই সত্যি। কিন্তু তা যেন গিলতে পারছে না বাইডেন সরকার। তারা ভাবতেও পারেনি এত তাড়াতাড়ি এত কিছু ঘটে যাবে, বাইডেন বলেওছেন সেটা। কিন্তু ঘটল তো…। অনেকেই বলছেন, বোমার পলতের খুব কাছে এসে গিয়েছিল আগুন, মার্কিন ফৌজ সরানোয় সেই দূরত্ব মুছে যা হওয়ার হয়েছে। তারা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আশরফ ঘানিকে একই সঙ্গে কাঠগড়ায় তুলছেন, নীরজ চোপড়ার ছোড়া বর্শার মতো ঘানির দিকে ছুটে যাওয়া প্রশ্ন: এত দিনেও কেন আফগান সেনাকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে পারলেন না ঘানি, নাকি কখনওই, কোনও ভাবেই তা চাননি এই নেতা? মাত্র ১০ দিনে নামমাত্র রক্তপাতে আফগানিস্তানে নিজেদের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে তালিবান, যেন এক তালিতে কেল্লা ফতে করে নিয়েছে। স্বপ্নিল সাফল্য বলা যায় একে।
অবশ্য মনে করা হচ্ছে, ঘানি তো তালিবানেরই হাতের পুতুল ছিলেন এক রকম, পুতুলটা শুধু সরে গিয়েছে, যারা পুতুল খেলা দেখাচ্ছিল তারাই ক্ষমতায়। বাহাত্তর বছরের আশরফ কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত। অনেকেই হয়তো জানেন না তাঁর শিক্ষার বহর, আশরফ ঘানি পিএইডি-ধারী, তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। রাষ্ট্রনির্মাণ ও সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে তাঁর গবেষণা। রাষ্ট্রনির্মাণ থুড়ি রাষ্ট্রধ্বংসের বড় কর্তব্য এখন এখন তালিবানের হাতে। আর আফগানিস্তানের সমাজব্যবস্থা অতল অন্ধকারে তলাচ্ছে। ঘানি সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে, আশ্রয়ে। দু'দশক আগে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে যে চারটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাদের একটি আমিরশাহি। তাদের আশ্রয়ে গনিকে দেখে তাই অনেকেই ভুরু কোঁচকাচ্ছেন। আমেরিকাও ঘানিকে গোনাগুনতির মধ্যে ফেলছে না আর, ফলে প্রমাদ গুনছেন ঘানিসাহেব।
তবে ৩১ অগস্ট আফগানিস্তান থেকে সেনা পুরো সরানোর যে ডেডলাইন ঘোষণা করেছিল বাইডেন সরকার, এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানাচ্ছেন, তা হচ্ছে না। ঘানিকে এই খবর ভরসা দিচ্ছে। দেশ ছাড়ার আগে বড় অঙ্কের অর্থ টুক করে বিদেশে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি। অভিযোগ উঠেছে। রবিবার দেশ ছাড়ার পর প্রথম তাঁকে দেখা গিয়েছে বুধবার, একটি ভিডিওয়ে। তিনি অর্থ সরানোর কথা অস্বীকার করেছেন তাতে, বলেছেন-- বিদেশ বিভুঁইয়ে বেশি দিন থাকার ইচ্ছা নেই, দ্রুত ফিরতে চান দেশে। তালিবানের সঙ্গে আফগান কর্তৃপক্ষের আলোচনা চলুক। এই যে তালিবানের এত বাড়, এই যে পুনর্দখল, তার জন্য দায়ী কারা-- না ঘানি নন মোটেই-- দায়ী: পাকিস্তান। সেই শুরু থেকেই তালিবানের পিছনে পাকাপাকি পাকিস্তান। কাবুলে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত গৌতম মুখোপাধ্যায় তালিবানের আফগানিস্তান দখল নিয়ে একটি লেখায় বলেছেন: 'পাকিস্তানের অনুপ্রবেশ, আফগানের চেহারায়', এটাই নির্জলা সত্য।
আরও পড়ুন তালিবান: এক জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ও নৈরাজ্যের পত্তন
কী ভাবে পাকাপাকি পাকিস্তান?
তালিবানের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে যে পাকিস্তান, তাদের অঙ্গুলি হেলনেই তালিবান এগিয়ে চলছে, তারা কোটি প্রমাণ ছড়ানো ছিটানো। তবে, ২০১০ সালে তালিবানের বড় নেতা মোল্লা আবদুল ঘানি বরাদরকে যে ভাবে করাচিতে গ্রেফতার করা হল, তাতে অনেকেই অবাক হয়ে যান। বিস্ময়ের প্রথমিক ঝলক কাটলে অবশ্য বোঝা যায় এর পিছনে খেলা রয়েছে অন্য। তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে তালিবানের সমঝোতা নিয়ে তাঁর যে আলোচনা চলছিল, তাতে জল ঢালতে এই গ্রেফতারি। এর পর যখন ট্রাম্প সরকার বলল, তারা আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তালিবানের সঙ্গে আলোচনা চায়, সেনা প্রত্যাহারের এই মার্কিন সিদ্ধান্তে খুশিতে ভেসে যেতে থাকে পাক সেনা এবং আইএসআই। তখন তালিবানের হয়ে আলোচনার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আবদুল বরাদরকে জেল থেকে ছেড়ে দিল পাকিস্তান। বরাদর জেলে গিয়েছিলেন ২০১০-এ। ছাড়া পেলেন, নির্দিষ্ট মিশনের স্বার্থে, ২০১৮-এ। ট্রাম্পের সময় সেনাপ্রত্যাহারের যে সিলমোহর পড়েছিল, তাতে পূর্ণতা এনেছেন বাইডেন, পাকিস্তান এই অগ্রগতি সম্ভব হত না। আর সে জন্যই আফগানিস্তানে তালিবানের এই সাফল্য আদতে পাকিস্তানেরই পরিকল্পিত-পথে সাফল্য-রচনা।
কোথায় আলো?
তালিবানের মুঠো হটাতে এখন অনেকেই প্রয়াত আফগান কম্যান্ডার আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমেদ মাসুদের দিকে তাকিয়ে (বাবা-ছেলের নাম প্রায় একই)। আহমেদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বে উত্তরের জোট বা নর্দার্ন অ্যালায়েন্স ১৯৯৬-এ তালিবান সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ভারত, ইরান, রাশিয়া এই জোটকে সমর্থন করেছিল, প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, অস্ত্রশস্ত্রও। পাঞ্জশির উপত্যকায় এদের প্রতাপ, একচ্ছত্র আধিপত্য। সেখানে নাক গলাতে পারে না তালিবান কিংবা অন্য কোনও শক্তি। আহমেদ শাহ মাসুদের দাপট ছিল নাকি রূপকথার মতো। পাঞ্জশিরের সিংহ বলা হত তাঁকে। শাহ মাসুদকে হত্যা করা হয়েছিল ২০০১-এ। এখন তালিবানের বিরুদ্ধে তাঁর ছেলের থেকে সেই টগবগানি দেখতে চাইছে আফগানবাসীদের একাংশ। লড়াইয়ের জন্য আমেরিকার থেকে অস্ত্রশস্ত্র চেয়েওছেন শাহপুত্র। এখানে ভুলে গেলে চলবে না, তালিবানের জন্মের পিছনে যেমন পাকিস্তান রয়েছে, তেমনই আছে আমেরিকাও, শুধু তা-ই নয়, যদি মার্কিন ফৌজ তালিবানকে ঝাড়েবংশে শেষ করতে ভিতর থেকে চাইত, তাহলে হয়তো পারত, কিন্তু চায়নি, যদিও সেই পথে চললে পাকিস্তানের সঙ্গেই তো সম্মুখসমর বাঁধত, সেটা কেন চাইবেন মার্কিন শাসকরা?
আরও পড়ুন নাজিবুল্লার মতো মরতে চাননি, তাই হয়তো পালিয়ে বাঁচলেন ঘানি!
আফগানিস্তান তালিবানের দখলে আসার ঠিক পরই নর্দান অ্যালায়েন্সের তরফে একটি দল পাকিস্তানে গিয়ে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, বিদেশমন্ত্রী শাহ মহম্মদ কুরেশি এবং সেনাপ্রধান বাজওয়ার সঙ্গে দেখা করে। পাকিস্তানের উপর তালিবানের বিরুদ্ধে চাপ তৈরির চেষ্টা করেন তাঁরা, কিন্তু চোরায় না শোনে ধর্মের কথা, কেনই বা শুনবে…! এখানে মনে করুন, সোমবার কী বলেছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান: আফগানিস্তানে 'কৃতদাসত্বের শিকল ভাঙল!' বাঁধিয়ে রাখার মতোই ভাষা, তাই না!