ইউক্রেন হামলায় রাশিয়ার বিচার চাই। গর্জন উঠেছে সারা বিশ্বে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের দরজা পেরিয়েও গিয়েছে তা। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট-- আইসিসি, রাশিয়ার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে এ মাসের শুরুতে। কিন্তু তদন্ত শুরু হওয়ায় লাভের লাভ কতটা হবে, সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কারণ, আন্তর্জাতিক এই ফৌজদারি আদালতে মামলা চলে, চলতেই থাকে, নিষ্পত্তির রা কাড়ে না, বেশির ভাগই। হিসেবের পাতা উলটে দেখা যাচ্ছে, শেষ দশ বছরে আইসিসি মাত্র ১০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। এ ছাড়া, দোষী সাব্যস্ত হয়ে সেই রায়ে পাত্তা দেন না অনেকে। এই আদালত তো আমার-আপনার বিচার করে না। তাঁরা পুতিনের মতো বাঘাবাঘাদের বিচার চালায়, ফলে পুতিন তাঁর বিরুদ্ধে রায়ে পাত্তা দেবেন কেনই বা!
যুদ্ধাপরাধ কী?
৪০ দেশের সদস্যদের অনুরোধে, ২ মার্চ, আইসিসি-র প্রধান বিচারপতি করিম খান রাশিয়ার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর কথা ঘোষণা করেছেন। অভিযোগটা হল, রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে, ফলে তারা যুদ্ধাপরাধী। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের বিধিতে যুদ্ধাপরাধের নিখুঁত সংজ্ঞা রয়েছে। এই সংজ্ঞায় যুক্ত হয়ে রয়েছে, একটি চুক্তিও, রোম আইন। তার গাইডলাইন্স অনুযায়ী, কোনও জনগোষ্ঠী যদি হামলার লক্ষ্য হয়, যা জেনেভা কনভেনশনকে ভঙ্গ করছে, তা হলে সেটা যুদ্ধাপরাধ। যুদ্ধাপরাধের মধ্যে রয়েছে খুন, অঙ্গহানি ঘটানো, অত্যাচার, পণবন্দি করে রাখা, ধর্ষণ এবং যৌন হেনস্থা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অস্ত্র ব্যবহারের উপরও অর্গল দিয়েছে। রাসায়নিক অস্ত্রও তাদের নিষেধের ঘেরাটোপে।
কী করে আইসিসি কাজ করে?
আইসিসির মূল দফতর নেদারল্যান্ডসের হেগে। স্বাধীন ভাবে কাজ করে এই বিচার প্রতিষ্ঠান। মূলত চারটি অপরাধের বিচার চালায়-- যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা এবং আগ্রাসন। প্রায় প্রতিটি দেশই, সব মিলিয়ে যা ১২৩-- যারা আইসিসি-র এক্তিয়ারে পড়ে। কারণ, এই সব দেশ স্বাক্ষর করেছে রোম আইন। কিন্তু এখানে একটা খটকা রয়েছে। ৩১টির মতো দেশ, এর মধ্যে রয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া, ইউক্রেন, যারা চুক্তিতে সই করলেও, তা গুরুত্বহীন হয়ে রয়েছে, কারণ সরকারি ভাবে চুক্তির অনুমোদন তারা দেয়নি। এর আগে ২০১৪ সালে, রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের বিরুদ্ধে এই আদালত রায় দেয়, তাতে পুতিনের দেশ আদালত থেকে নিজেদের সরিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন Explained: রাশিয়াকে ‘না’ একাধিক সংস্থার, কারা রয়েছে তালিকায়?
আদালত কোনও দেশ নয়, কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা চালায় প্রধানত। কোনও ব্যক্তি অভিযুক্ত হলেই তো তিনি তাঁর দেশকে টেনে আনবেন। কান টানলে মাথা আসার মতো। যেমন পুতিন যদি দোষী সাব্যস্ত হন, রাশিয়াও আসবে, তাদের নিন্দাও হবে আরও বেশি করে। তবে, আগেই বলেছি আমার আপনার মতো সাধারণ কেউ এই আদালতের কাঠগড়ায় ওঠে না। বা তাদের কথায় কিছু যায় আসেও না। পুতিন বা তেমন হেভিওয়েট কেউই এর নজরে আসে। তাদের নিয়েই এর কাজকারবার।
আরও পড়ুন Explained: পোল্যান্ডে মার্কিন সেনা-অস্ত্র সাহায্য কেন, রুশ-ইউক্রেন সংঘাতে এর তাৎপর্যটা কী?
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা নিয়ে আগেকার এবং এখনকার, দুই অভিযোগই গুরুতর। আগেরটি ক্রিমিয়া সম্পর্কিত, ২০১৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পরের ঘটনা, তখন ইউক্রেনে থিতিয়ে যাচ্ছে মর্যাদার আন্দোলন। যে আন্দোলন ছিল 'রুটির ঝুড়ি'-র প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে। প্রেসি়ডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ রাশিয়াকে পাত্তা না দিয়ে ইইউ বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন, তাতেই শুরু হয় বিক্ষোভ, পাল্টা আসে পুলিশ বাহিনীর বেধড়ক। মৃত্যুমিছিল দেখে ইউক্রেনের পথঘাট, হয়ে ওঠে রক্তস্নাত। এর পরই পুতিন স্থির করে ফেলেন ক্রিমিয়া নেমেন। সেই মতো কিছু সেনা, স্থানীয় উগ্রপন্থীদের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন ইউক্রেনের এই অংশে। এবং ছেলের হাতের মোয়ার মতো নিয়ে ফেলেন দেশটিকে। এর পর একটি গণভোট হয়, রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়া থাকবে কিনা, তা নিয়ে। দেখা গেল ৮১.১ শতাংশ ভোট পড়েছে, তার মধ্যে ৯৬.৭ শতাংশই চাইছে রাশিয়ায় মিশে যেতে। যদিও রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় এই ভোটকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে পুতিনের কিছু যায় আসেনি, তিনি ক্রিমিয়াকে স্বাধীন ঘোষণা করেছেন, নিজের তাঁবে রেখে দিয়েছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জে যুদ্ধাপরাধের কালিকে তিনি কুলকুচো করে ফেলে দিতে জানেন। যেমন এখনও সেই পথেই এগিয়ে প্রমাণ করছেন, পুতিনের বদল নেই।